ইকারিয়া বিশ্বের পাঁচটি ব্লু জোনের একটি। ব্লু জোন বলতে সেসব অঞ্চল বোঝায়, যেখানকার মানুষদের মধ্যে শতবর্ষী হওয়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এজিয়ান সাগরের পূর্ব অংশের গ্রিকের ছোট দ্বীপটির স্থায়ী বাসিন্দা আট হাজারের কিছু বেশি। সেখানে অন্যান্য অনেক জায়গার তুলনায় ক্রনিক ডিজিজ বা দীর্ঘস্থায়ী রোগের হার কম।

পৃথিবীর যে কয়েকটি স্থানের বাসিন্দারা দীর্ঘ জীবন লাভ করেন, গড় আয়ুর বিচারে সেখানকার জনগোষ্ঠী তার অন্যতম। প্রকৃতপক্ষে এক তৃতীয়াংশ ইকারিয়ান ৯০ বছরের বেশি বেঁচে থাকেন। দৃঢ় সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন, নিয়মিত শরীর চর্চা এবং প্রয়োজন মাফিক ঘুম, ইত্যাদি এই দ্বীপের বাসিন্দাদের শতবর্ষী হওয়ার কারণ বলে মনে করা হয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হলো তাদের খাদ্যাভ্যাস।

অর্থাৎ, তারা কী ধরনের খাবার গ্রহণ করে। মেডিটারেনিয়ান ডায়েট বা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের খাদ্যাভ্যাস স্বাস্থ্যকর হিসেবে সুপরিচিত। এই ডায়েটের সঙ্গে মিল আছে ইকারিয়া ডায়েটের। এতেও স্বাস্থ্যকর চর্বি, প্রচুর আঁশ বা ফাইবার এবং পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার অন্তর্ভুক্ত থাকে।

এই খাদ্যাভ্যাস ব্যাপকভাবে উদ্ভিজ্জ নির্ভর। বাদাম, আলু, লেবু, শাকসবজি, শস্য ও বীজের আধিক্য থাকে সেখানে। ফ্যাট বা চর্বির প্রধান উৎস হিসেবে থাকে জলপাই তেল। দই, পনির, মাছ, পোল্ট্রি ও রেড ওয়াইন পরিমিত খাওয়া হয়। লাল মাংস খাওয়া হয় খুবই সীমিত পরিমাণে, মাসে কয়েকবার।

দেখা গেছে, এমন নিয়ম মেনে খাবার নির্বাচনে অনেক রোগের ঝুঁকি কমে যায়। হ্রাস পায় হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, উচ্চ কোলেস্টেরল, স্থূলতা ও উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগের নেপথ্য কারণগুলো।
ডায়ান কোচিলাস নামে একজন গ্রিক-আমেরিকান শেফ সম্প্রতি একটি রান্নার বই লিখেছেন। নাম দ্য ইকারিয়া ওয়ে। শেফ ডায়ান কোচিলাস তার এই নতুন বইয়ে দ্বীপটির বাসিন্দাদের খাবারের আলোকে একটি ‘প্ল্যান’ দিয়েছেন। যারা নিজেদের পাতে মেডিটারেনিয়ান ঘরানা নিয়ে আসতে চান তাদের জন্য এই পরামর্শ।

বইটি দুটি প্রশ্নে আলোকপাত করে : কিভাবে ‘মনকে কষ্ট না দিয়েও’ শরীরকে ভালো রাখা যায় এবং রান্নাটা কিভাবে করতে হবে। প্রশ্নগুলোর উত্তর তিনি খুঁজেছেন প্রশান্তি ও স্বস্তিদায়িনী দ্বীপটির সরল ও মৃদুগতির জীবনের অনুপ্রেরণায়। যেখানে মানুষে মানুষে বন্ধন গড়ে ওঠে খাবার টেবিলকে ঘিরে। নানান রকম খাবারের কথা বলা হয়েছে বইয়ে। এতে দই, শসা ও আখরোট স্যুপের মতো হালকা খাবার, স্ন্যাকস, বড় বা মাঝারি লোকসমাগমের ডিনারের রেসিপি যেমন মিলবে তেমনি পাওয়া যাবে পনিরে ভাজা পিচ এবং আরগুলা সালাদ; রেড ওয়াইনে ভাজা মশলাদার মটরশুটি; পেস্তা-কিসমিসের পোলাওয়ের মত পদ।

ডায়ান কোচিলাস বলেন, ‘লোকে যে পরিমাণ চাপ নেয়, এটা আমাকে রীতিমত অবাক করে। আমেরিকাতে খুব দেখা যায়, স্ট্রেস নিয়ে লোকে নিজের ক্ষতি করে। বেশির ভাগ সময় আমাদের মাথার ভেতরেই কেবল এর অস্তিত্ব থাকে, চিন্তার ধরণের কারণে যা তীব্র হয়।’

তার বইয়ের লক্ষ্য, মানুষ যেন নিজের যত্ন সম্পর্কে আরো সচেতন হয়। কোচিলাস দেখাতে চান, ‘খাবারও একটা ভালোবাসার নাম।’

ইকারিয়ার নিরামিষ খাবারগুলোতে স্বাস্থ্যের উৎকর্ষ ও মনের সন্তুষ্টি যেমন আসে, বাস্তবতার বিচারেও এগুলো তৈরি করা সুবিধাজনক। গ্রিসের অন্যান্য অংশের মতো এই দ্বীপেও কিছু মানুষ এখনো গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের দিনপঞ্জি অনুযায়ী উপবাস ব্রত পালন করে থাকে। তাই বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়, যেমন লেন্টের (ইস্টারের আগের ৪০ দিনের উপবাস) সময় মাংস খায় না।

কোচিলাসের রান্নার বইয়ে যেসব উপাদানের কথা বলা হয়েছে সেগুলো ইকারিয়াতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। যার মধ্যে রয়েছে দই, বাদাম, মধু, সামুদ্রিক লবণ, জলপাই তেল, বাদাম, টাটকা ভেষজ উপাদান, নানাবিধ শস্য, রসুন ও বিভিন্ন ধরনের লেবু। বিশ্বের যেকোন প্রান্তের সুপারমার্কেটেই এগুলোর কাছাকাছি পণ্য পাওয়া যাবে বলে উল্লেখ করেছেন কোচিলাস।

দ্য ইকারিয়া ওয়েতে শিমজাতীয় খাদ্যের জয়জয়কার। যত পদের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে, এগুলোকে কোচিলাস বিশেষ স্থান দিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে দুয়েকটির কথা বলা যায় – মটরশুটি, তাহিনি (এক ধরনের তিল বাটা) এবং দই; ফাভা বিন (বিশেষ জাতের শিমের বিচি) স্টু; মরিচ দিয়ে কিডনি বিন; হলুদ, মৌরি ও লেটুসসহ ক্যারামেলাইজড জাম্বো বিন।

সূত্র : বিবিসি