ভিডিও

হতাশা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো

সাদিয়া এখন বিশ্বের ১৪টি নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী

প্রকাশিত: জুন ০৯, ২০২৪, ১০:২৭ রাত
আপডেট: জুন ১০, ২০২৪, ০৩:০৭ দুপুর
আমাদেরকে ফলো করুন

নাসিমা সুলতানা ছুটু : বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে এবং পরবর্তীতে ক্যাডেট কলেজে ভর্তির সুযোগ না পাওয়ার হতাশাকে কীভাবে সাফল্যের চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে যেতে হয় তা দেখিয়ে দিয়েছেন সাদিয়া ইয়াসমিন শ্রাবণী। স্বপ্ন ছিলো পাইলট হয়ে বিশ্বজুড়ে ঘুরবেন। কিন্ত সপ্তম শ্রেণিতে সেই স্বপ্নভঙ্গের পর নিজের আত্মবিশ্বাসের উপর ভর করে ভালো পড়ালেখা করার পাশাপাশি বাড়াতে থাকেন সহশিক্ষা কার্যক্রম।

সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলো সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করে আজ তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের স্ক্রিপস ক্লারমন্ট কলেজে প্রায় চার কোটি টাকার বৃত্তি নিয়ে পড়ালেখা করার সুযোগ পেয়েছেন। শুধু কী তাই? আমেরিকা এবং কানাডার ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করে ১৪টিতেই সম্পূর্ণ জীবিকা ভাতাসহ বৃত্তি নিয়ে স্নাতক প্রোগ্রামে ভর্তি হওয়ার হওয়ার সুযোগ এসেছে তার।

সাদিয়া ইসলাম শ্রাবণীর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে বগুড়ার কাহালু উপজেলায়। শিক্ষক বাবা-মা’র চাকরির সুত্রে কাহালুতে থাকা হলেও তাদের আদি বাড়ি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার মাঝিহট্ট গ্রামে। কাহালুর একটি প্রাইমারী স্কুলে পড়াকালীন বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দেন। কিন্ত কঠিন প্রতিযোগিতামূলক ওই পরীক্ষায় টিকতে না পেরে শিশুমনে ভীষণ আঘাত পান সাদিয়া। কিন্তু সেই কষ্টকে পাত্তা না দিয়ে আবারও ভালোভাবে পড়ালেখা করা শুরু করে দেন।

স্বপ্ন দেখতে থাকেন ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়ে পাইলট হবেন। তার স্বপ্ন অনুযায়ী বাবা-মা’ও বগুড়া শহরের একটি কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দেন। কাহালু থেকে প্রতিদিন বগুড়ায় এসে সাদিয়া ক্যাডেট কোচিং করেন এবং কোচিংয়ের প্রতিটি পরীক্ষায় বেশ ভালো ফলাফল করতে থাকেন। ক্যাডেট কলেজের চূড়ান্ত ভর্তি পরীক্ষায় টিকতে না পেরে আবারও হতাশ হন সাদিয়া।

এরপর কাহালু মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়তে সুযোগ না পাওয়ায় তার মনে এক ধরণের আকাঙ্খা থাকে। মনে হতে থাকে যাদের সাথে কোচিং করেছে তারা সবাই শহরের ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করেন, কিন্ত তিনি গ্রামের একটি অখ্যাত স্কুলে পড়ালেখা করছেন। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সাদিয়া আবৃত্তি, অভিনয়, গান, নাচ, ছবি আঁকা, বিতর্কসহ নানা সহশিক্ষা কার্যক্রম প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে থাকেন।

ওই স্কুল থেকেই সাদিয়া ২০২০ সালে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাশ করেন। এরপর বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে ভর্তি হয়ে ওই কলেজ থেকে ২০২২ সালে জিপিএ-৫সহ এইচএসসি পাশ করেন। সহশিক্ষা কার্যক্রমের কল্যাণে সাদিয়া ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে ৭বার জেলায় এবং দুইবার বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী নির্বাচিত হওয়াসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ১২৩টি পদক তার ঝুলিতে রয়েছে।

সাদিয়া তার শৈশব সম্পর্কে বলেন, আমার বাবা-মা’ দু’জনেই কাহালু মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। বাবা ছিলেন ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং মা সহকারী শিক্ষক। মা ছিলেন বেশ রক্ষণশীল। মা কারো সঙ্গে মিশতে দিতেন না। এজন্য তিনি স্কুল সংলগ্ন স্থানে বাসা ভাড়া নেন। স্কুল শেষে সোজা বাসায় যেতে হত। আমার সঙ্গী ছিলো টেলিভিশন।

মূলত টেলিভিশন থেকেই আমি সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলো আয়ত্ত করে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে থাকি। আর বিটিভির সিসিমপুর দেখে সুন্দর করে কথা বলতে শিখি। সবারই শৈশব রঙিন থাকলেও আমার জন্য তা ছিলো না। বাবা-মা’র স্কুলেই আমি পড়েছি, সেটি শুরুতে কেবল ছেলে শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল। পরে ছেলে-মেয়ে উভয় ধরণের শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য রূপান্তর করা হয়েছে।

রূপান্তর করা হলেও নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় সেই স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে একমাত্র মেয়ে শিক্ষার্থী ছিলাম আমি। তাই দেখা যেত, ক্লাস বা পরীক্ষায় একাই বসতে হতো। সহশিক্ষা কার্যক্রম ছাড়াও অষ্টম শ্রেণি থেকে সাদিয়া সমাজসেবামূলক বিভিন্ন কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

স্বর্ণকিশোরী স্কুল ক্লাব প্রেসিডেন্ট হয়ে বাল্যবিবাহ রোধসহ স্কুলের শিক্ষার্থীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের সচেতনতা এবং বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন।  বগুড়ার থিয়েটার আইডিয়াতে যোগ দিয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করেছেন। অষ্টম শ্রেণি থেকে অলিম্পিয়াড করা শুরু করেন। সেই সুবাদে ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক ফলিত রসায়ন অলিম্পিয়াডে ব্রোঞ্জপদক পান। একই বছর ইউএসএ মেডিকেল অ্যান্ড ডিজিজ অলিম্পিয়াডে বিশ্বের সেরা ১০ শতাংশের (স্কোর ১১২/১৫০) মধ্যে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করেন।

বিডি-ক্লিনে যোগ দিয়ে শহর পরিস্কার রাখা এবং বিআইও-আইকন, এ যোগ দিয়ে ডেঙ্গু নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করেছেন। এছাড়া ৫দিনের হাইস্কুল সামার প্রোগ্রামে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনট্রোডাকশন টু বায়ো মেডিকেল রিসার্চ করেছেন। ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল সায়েন্স অলিম্পিয়ার্ড-২০২৪ এ অংশ নিয়ে অনারারেবল ম্যানশন এ্যাওয়ার্ড পেয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। পিকেএসএফ’র ন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।

লাঠিখেলার উপর তার লেখা একটি গবেষণাপত্র বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছে। এছাড়া দৈনিক করতোয়ার ‘সবুজ আসর’ এবং প্রথম আলোর কিশোর আলো’তে তার একাধিক কবিতা এবং গল্প প্রকাশ হয়েছে। এ সবই তার বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করেছে বলে সাদিয়া জানান।  যুক্তরাষ্ট্রের স্ক্রিপস ক্লারমন্ট কলেজে ফুলরাইড স্কলার হিসেবে পড়াশোনার সুযোগ পাওয়া সম্পর্কে সাদিয়া বলেন, ঘড়িতে সময় রাত প্রায় সাড়ে চারটা।

অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ভার্চুয়াল সাক্ষাৎকার দিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তখন যুক্তরাষ্ট্রের স্ক্রিপস ক্লারমন্ট কলেজে ভর্তির জন্য অফার লেটারসহ ই-মেইল পাই। ই-মেইলের প্রথম শব্দটা ছিল অভিনন্দন। আর পুরো ই-মেইলটি পড়ে তো কেঁদেই ফেলেছিলাম। কারণ, এর আগে কোনো বাংলাদেশী শিক্ষার্থী এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাননি।

আর এবার দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র শিক্ষার্থী হিসেবে আমিই ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছি। সব মিলিয়ে মোট ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আবেদন করেছিলাম। এ সময় ১২ বছরের সব অর্জন যথাযথভাবে কমন অ্যাপে উপস্থাপনের চেষ্টায় কোনো ছাড় দিইনি। এর ফল হিসেবে স্ক্রিপস ক্লারমন্ট কলেজ, কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া কলেজ সহ ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্পূর্ণ জীবিকা ভাতাসহ বৃত্তি নিয়ে স্নাতক প্রোগ্রামে ভর্তি হওয়ার সুযোগ এসেছে।

ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে স্ক্রিপস কলেজ সাদিয়াকে প্রতি বছর প্রায় ৪ কোটি টাকা দেবে। থাকা-খাওয়াসহ তার সব ব্যক্তিগত খরচ পূরণ হবে এই বৃত্তির মধ্য দিয়ে। পাশাপাশি ইন্টার্নশিপসহ স্ক্রিপস ক্লারমন্ট কলেজের গবেষণা কেন্দ্রে প্রথম সেমিস্টার থেকেই বিভিন্ন গবেষণাকাজে যুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া আমাদের লাসপা লিডারশিপ সেন্টারে বিশ্বের নানা উদ্যোগ নিয়ে কাজ করা হয়।

সাদিয়ার কাছে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেতে কী করা প্রয়োজন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবদিক থেকে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হবে। কমিউনিকেশন স্কিল বাড়াতে হবে এবং সহ-শিক্ষা কার্যক্রমগুলোতে অংশ নিতে হবে।

সবচেয়ে ভালো প্রস্তুতি নেওয়ার সময় হচ্ছে অষ্টম-নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য। কারণ, ভর্তিপ্রক্রিয়া মূলত কোনো নির্দিষ্ট একটি পরীক্ষার ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হয় না। এ ক্ষেত্রে একাডেমিক ফল তেমন মুখ্য নয়, পাশাপাশি ব্যক্তিগত মান, অর্জনসহ অনেক কিছুই নির্ভর করে। বৃত্তি দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সবার আগে একজন ভালো মানুষ ও প্রকৃত নেতা খোঁজে। তাই স্বপ্ন থাকলে শুরু থেকে নিজেকে যথাযথভাবে গড়ে তোলার কাজ করে যেতে হবে।

সাদিয়া তার আজকের এই অর্জনের জন্য বাবা এফ এম এ সালাম এবং মা ফরিদা ইয়াছমিনের পাশাপাশি তার শিক্ষক সুব্রত কুমার সাহা, আব্দুর রউফ হোসেন, আরিফুল ইসলাম জুয়েল, সাদেকুর রহমান সুজনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে সাদিয়া জানান, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান নিয়ে পিএইচডি করারও তার ইচ্ছে রয়েছে।

উত্তরবঙ্গে সায়েন্স এন্ড কালচার সেন্টার গড়ার আকাঙ্খা রয়েছে। এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে এবং শিশু ও নারীদের সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করতে চান।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS