ভিডিও

নীরবে বিষ ছড়াচ্ছে পার্থেনিয়াম উদ্ভিদ

প্রকাশিত: জুন ১০, ২০২৪, ১০:৩০ রাত
আপডেট: জুন ১১, ২০২৪, ০১:১৩ দুপুর
আমাদেরকে ফলো করুন

শাওন রহমান : রাস্তার দু’ধারে, ঝোপঝাড়ে কিংবা ফসলের ক্ষেতের পাশে দুই থেকে আড়াই ফুট লম্বা সবুজ গাছ। সবুজ পাতার মাঝে দৃষ্টিকাড়া ছোট ছোট সাদা ফুলের সমারোহে নয়নাভিরাম এক দৃশ্য। প্রকৃতির শোভা বাড়িয়েছে পার্থেনিয়াম উদ্ভিদ।

আপাত এটি দৃষ্টিকাড়া হলেও নীরবে বিষ ছড়াচ্ছে পার্থেনিয়াম নামের ছোট এই আগাছা। বিষাক্ত এই গাছ থেকে হতে পারে নানা রোগ। কিন্তু স্থানীয় মানুষের কোনও ধারণাই নেই বিষাক্ত এই গাছ সম্পর্কে, খোদ ধারণা নেই কৃষি মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও।

বাংলাদেশে কয়েক বছর যাবৎ এই গাছ রাস্তার দু-ধারে, জমির আইলে দেখা যাচ্ছে। এ গাছের পাতা অনেকটা গাজর গাছের মতো। জানা যায়, বিষাক্ত পার্থেনিয়ামের মূল উৎপত্তিস্থল মেক্সিকো। সেখান থেকে এটি ছড়িয়ে পড়ে আমেরিকা, আফ্রিকা, ভারত, পাকিস্তান, চীন, নেপাল, অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশেসহ বিভিন্ন দেশে।

পার্থেনিয়ামের একটি গাছ চার হাজার থেকে ২৫ হাজার অতিক্ষুদ্র বীজের জন্ম দিতে পারে। একটি গাছ বাঁচে তিন থেকে চার মাস। এই সময়ের মধ্যেই তিনবার ফুল ও বীজ দেয়। এই বীজ এতো ক্ষুদ্র যে সাধারণত গবাদিপশুর গোবর, গাড়ির চাকার কাদামাটি, পথচারীদের জুতা-স্যান্ডেলের তলার কাদামাটি, সেচের পানি ও বাতাসের সঙ্গে এর বিস্তার ঘটে।

পার্থেনিয়াম একজাতীয় ছোট উদ্ভিদ হলেও প্রাণিজগৎ ও মানবজীবনে এর রয়েছে নানান ক্ষতিকর প্রভাব। এই আগাছায় ‘সেসকুইটারপেন ল্যাকটেনস’ নামক টক্সিন বা বিষ থাকে। এই বিষ মানুষসহ অন্যান্য জীবের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। এছাড়াও এই আগাছা এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে যা অন্যান্য ফসলের বৃদ্ধি হ্রাস করে।

ক্ষেতের ফসল বা উদ্ভিদের কাছে পার্থেনিয়াম থাকলে সেই ফসলের ফলন মারাত্মক হারে কমে যায়। এছাড়া কীট-পতঙ্গের পরাগায়নের মাধ্যমে পার্থেনিয়ামের পরাগ রেণু অন্য উদ্ভিদের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে কীটপতঙ্গ ও ফসল উভয়ের ক্ষতি করে।

পার্থেনিয়াম উদ্ভিদের শোষণ কৃত কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণে বাধা প্রদান করে এবং সালোক-সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক বাধা প্রদান করে। পার্থেনিয়াম আগাছা ফসলি জমিতে থাকলে ফসলের উৎপাদন প্রায় ৪০ শতাংশ কমিয়ে দেয়।

বিশেষ করে ভুট্টার ক্ষেত্রে এ আগাছা ফল ধরার পর প্রাথমিক অবস্থায় মোচার ফল ধারণ ক্ষমতা ৩০ শতাংশ হ্রাস করে। এছাড়া ধান, ছোলা, সরিষা, গম, বেগুন এবং মরিচের ক্ষেত্রে এ আগাছা বীজের অঙ্কুরোদগম ও বৃদ্ধি কমিয়ে দিয়ে ফসলের ফলন অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। পার্থেনিয়াম গাছের গোঁড়া থেকে আগা এর পরাগ, ডালপালা সবই মারাত্মক ক্ষতিকর।

প্রাণিজগতেও মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে এটি। পার্থেনিয়াম আগাছাযুক্ত মাঠে গবাদিপশু চরানো হলে পশুর শরীর ফুলে যায়, তীব্র জ্বরসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয় এবং পশুর বদ হজম দেখা দেয়। পার্থেনিয়াম গাছ খেলে গবাদি পশু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকে। আর এই ভাইরাস আক্রান্ত পশু জবাই করে এর মাংস খেলে মানুষের শরীরও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়।

যার ফলে মানবশরীরে দেখা দেয় এজমা, ব্রঙ্কাইটিস, ফুসফুসে ক্যান্সাসহ বিভিন্ন রোগ। এছাড়াও আক্রান্ত ব্যক্তির যৌন ক্ষমতা হ্রাস পায়। পার্থেনিয়াম আগাছা হাত দিয়ে স্পর্শ করলে বা চটকালে ছোট থেকে পরবর্তীতে বড় ধরনের রোগ দেখা যায়। প্রাথমিক অবস্থায় হাত-পা চুলকায়, লাল হয়ে যায় এবং বৃহৎ আকারে ত্বকে ক্যান্সারের সৃষ্টি করে। আক্রান্ত ব্যক্তি ঘন ঘন জ্বরে আক্রান্ত হয় এবং অসহ্য মাথা ব্যথা ও উচ্চ রক্তচাপে ভোগে।

অথচ সাধারণ মানুষ কিংবা মাঠের কৃষকদের কোন ধারণা নেই বিষাক্ত এই গাছ সম্পর্কে। এমনকি মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাও জানেন না পার্থেনিয়াম গাছের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে। বগুড়া সদরের ভাটকান্দি এলাকার কৃষক মধু মিয়া বলেন, বর্ষার শুরুতে তার জমিতে প্রচুর এ আগাছা জন্মে। উদ্ভিদটিকে সাধারণ আগাছার মতোই মনে হয়। কিন্তু এ সম্পর্কে জানতে পেরে এখন আতঙ্কিত তিনি।

কৃষক আফসার উদ্দিন ও আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এ গাছ সম্পর্কে তাদের আগে কোন ধারণা ছিল না। এ বিষয়ে আরও প্রচারের প্রয়োজন আছে। তা না হলে কৃষি ও জীবন-দুটিই হুমকির মুখে পড়বে। এছাড়াও আগাছাটির ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানা না থাকায়, মাঠে খেলার সময় ঝোপের ভেতর দিয়ে অনায়াসেই চলাচল করছেন শিক্ষার্থীরা। ফলে নিজের অজান্তেই বাড়ছে চর্মরোগ, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট ও ক্যান্সারের মতো জটিল রোগসমূহে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি।

জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বগুড়ার উপ-পরিচালক মতলুবর রহমান বলেন, বিভিন্ন মাধ্যমে তারা পার্থেনিয়াম উদ্ভিদের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জেনেছেন। তবে এ ব্যাপারে কোন নির্দেশনা তাদের কাছে নেই।

এমনকি উদ্ভিদটির প্রভাবে ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছেন এমন কোন তথ্যও এখন পর্যন্ত তাদের কাছে নেই। এই কর্মকর্তা আরও বরেন, এই অঞ্চলে পার্থেনিয়ামের মতো যে উদ্ভিদ দেখা যাচ্ছে তা প্রকৃত অর্থেই ক্ষতিকর কিনা তা পরীক্ষার পর বলা যাবে।

আমাদের সারিয়াকান্দি প্রতিনিধি জানিয়েছেন, এ উপজেলার সড়কসহ প্রায় এলাকাতেই বাড়ছে বিষাক্ত পার্থেনিয়াম গাছ। গাছটির বিষাক্ততা সম্পর্কে শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষই অজানা। বগুড়া-সারিয়াকান্দি সড়কে যাতায়াত করতেই চোখে পড়বে পার্থেনিয়াম জাতীয় বিষাক্ত গাছের।

সড়কটির সারিয়াকান্দি উপজেলার হাটফুলবাড়ী আমতলী এলাকায় এ গাছ সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদের প্রায় সবাই এ গাছের বিষাক্ততা সম্পর্কে জানেন না। দুপচাঁচিয়া প্রতিনিধি জানান, এ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মাঠে-ঘাটে ছড়িয়ে পড়েছে পার্থেনিয়াম উদ্ভিদ।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মিল কারখানা পরিত্যাক্ত জায়গাসহ রাস্তার দু’ধারে, পুকুরের পাড় ও জমির আইলের পাশে পার্থেনিয়াম উদ্ভিদ জন্ম নিয়েছে। আগাছাটি নীরবে ক্ষতি করলেও জানেন না সাধারণ মানুষ।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS