ভিডিও

বগুড়া

শজিমেক হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকলেও উপজেলা হাসপাতালে তেমন নেই

চিকিৎসকদের দাবি- ‘আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই’

প্রকাশিত: জুন ২৪, ২০২৪, ১১:১৫ রাত
আপডেট: জুন ২৫, ২০২৪, ১২:০৪ রাত
আমাদেরকে ফলো করুন

নাসিমা সুলতানা ছুটু :  বর্ষাকাল এলেই গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে আতঙ্কের বিষয় হয়ে ওঠে সাপের দংশন। এবার এই আতঙ্কের সাথে যুক্ত হয়েছে রাসেলস ভাইপার (চন্দ্রবোড়া)।

বিশেষ করে নদী বেষ্টিত এলাকা, চরাঞ্চল এবং গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যে এই আতঙ্ক বেশি কাজ করছে। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, রাসেলস ভাইপার (চন্দ্রবোড়া) নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেভাবে ভীতি ছড়ানো হচ্ছে, এটা ঠিক নয়। কোন রোগীকে যদি সাপে কাটে তবে তাকে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে। কোনভাবেই ফকির বা কবিরাজের কাছে না নিয়ে যাওয়া উচিৎ নয়।

যে কোনো বিষধর সাপ কাটার পর অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ জরুরি হয়ে যায়। অন্যথায় রোগীর মৃত্যু ঝুঁকি বেশি। একজন সাপে কাটা রোগীর শরীরে ১০টি অ্যান্টিভেনম প্রয়োগের প্রয়োজন হয়। বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতাল, ২৫০ শয্যা মোহাম্মদ আলী হাসপাতালসহ কয়েকটি উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শজিমেক হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীদের শরীরে প্রয়োগের জন্য অ্যান্টিভেনমের মজুদ পর্যাপ্ত থাকলেও মোহাম্মাদ আলী হাসপাতালসহ উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে অ্যান্টিভেনমের তেমন সরবরাহ নেই।

এদিকে গতকাল রোববার বগুড়ার ধুনটে সাপের কামড়ে এক কিশোরী মারা গেছে। ওই রোগীকে উপজেলা হাসপাতালে নিলেও রোগীর অবস্থা বেশ সঙ্কটজনক হওয়ায় তাকে বগুড়া শজিমেক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়, কিন্তু ওই কিশোরীর পরিবার তাকে হাসপাতালে না নিয়ে তাকে কবিরাজের কাছে নিলে কিছুক্ষণ পর কিশোরীটি মারা যায়। এর আগ গত ৩০ মার্চ মাসে বগুড়ার শেরপুুরে সাপের কামড়ে এক কলেজ ছাত্রী মারা যায়।

বগুড়া শজিমেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে ওই হাসপাতালে ৪১৮জন সাপে কাটা রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। এরমধ্যে কোন রোগী মারা যায়নি। সবচে’ বেশি সংখ্যক সাপে কাটা রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন জুলাই ও আগস্ট মাসে। ওই সময় বর্ষা মৌসুম হওয়ায় সাপের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। গত বছরের জুলাই মাসে ৭২ জন এবং আগস্ট মাসে ৯৮জন সাপে কাটা রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।

সাপে কাটা যেসব রোগী চিকিৎসা নিতে এসেছেন তাদের সকলেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, হাসপাতালে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনমের মজুদ রয়েছে। সাপে কাটা রোগী এলে তার যথোপযুক্ত চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা হবে। অ্যান্টিভেনম যদি মজুদ নাও থাকে তবে তাৎক্ষণিক কিনে এনে রোগীর শরীরে প্রয়োগ করা হবে।

এদিকে বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসার জন্য এখন পর্যন্ত কোন অ্যান্টিভেনম নেই। ওই হাসপাতালে কোন রোগী এলে তাকে বগুড়া শজিমেক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। তবে অ্যান্টিভেনম’র জন্য স্বাস্থ্য বিভাগে যোগাযোগ করা হয়েছে, দুই একদিনের মধ্যে ওই হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম চলে আসবে।

বগুড়ার নন্দীগ্রাম ও সোনাতলা উপজেলা হাসপাতালে মাত্র একজন রোগীর শরীরে প্রয়োগের জন্য অ্যান্টিভেনম মজুদ রয়েছে, সারিয়াকান্দি উপজেলা হাসপাতালে ২জন রোগীর শরীরে প্রয়োগের জন্য অ্যান্টিভেনম মজুদ রয়েছে, ধুনট উপজেলা হাসপাতালে ২০জন রোগীর জন্য অ্যান্টিভেনম মজুদ রয়েছে এছাড়া শেরপুর উপজেলা হাসপাতালেও অ্যান্টিভেনমের মজুদ একেবারে নেই বলে জানা গেছে।

ধুনট প্রতিনিধি জানান, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছয় মাসে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসাসেবায় ৭ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন এবং  ফারজানা আকতার (১৬) নামে এক স্কুলছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। নিহত ফারজানা আকতার উপজেলার উত্তর কান্তনগর গ্রামের ফরিদুল ইসলামের মেয়ে এবং কান্তনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীর ছাত্রী। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসার পর বাড়িতে নিয়ে ওঝা ঝাড়ফুঁক দেওয়া অবস্থায় অবস্থায় গতকাল রোববার সকালের দিকে ফারজানার মৃত্যু হয়।

শেরপুর প্রতিনিধি জানান, গত ছয়মাসে ওই উপজেলার দশটি ইউনিয়নে সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়েছেন অন্তত দুই শতাধিক মানুষ। এরমধ্যে বেশির ভাগ রোগী স্থানীয়ভাবে গ্রাম্য কবিরাজী চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। তবে গুরুতর নয়জন রোগী স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছিল। এছাড়া আক্রান্তদের মধ্যে সুমাইয়া খাতুন নামের এক কলেজছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে।

গত ৩০ মার্চ রাতে উপজেলার খানপুর ইউনিয়নের খাগা গ্রামে ওই সাপে কাটার ঘটনাটি ঘটে। নিহত সুমাইয়া খাতুন ওই গ্রামের রফিকুল ইসলামের মেয়ে এবং শেরপুর টাউন ক্লাব পাবলিক লাইব্রেরি মহিলা অনার্স কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী।

বগুড়া জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, সাপে কাটা রোগীদের জন্য বগুড়ায় উপজেলা পর্যায়ে মাত্র ১৮৩টি ভায়াল এবং শজিমেক হাসপাতালে ৩৭০ ভায়াল মজুদ রয়েছে। বগুড়া শজিমেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডাঃ আব্দুল ওয়াদুদ জানান, হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম মজুদ রয়েছে। এরপরও যদি সঙ্কট হয় সেক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক কিনে এনে রোগীর শরীরে প্রয়োগ করা হবে। তিনি আরও বলেন, সাধারণতঃ বর্ষা মৌসুমে সাপের উৎপাত হয়।

এটি নতুন নয়। রাসেলস ভাইপার নামে যে সাপের কথা বলে সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে, এটি আসলে ঠিক নয়। সাপ খুবই অলস প্রাণী। সাপকে বিরক্ত না করলে সাপ কাউকে কাটে না। আর কাউকে যদি সাপ কাটে তবে দেরি না করে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।

এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। কিন্ত আমাদের গ্রামাঞ্চলে বেশির ভাগ মানুষই সাপে কাটা রোগীদের আগে চিকিৎসকের কাছে না নিয়ে কবিরাজের কাছে ছোটেন। রোগীর অবস্থা যখন আশঙ্কাজনক হয় তখন তারা চিকিৎসকের কাছে আনেন। প্রথমেই নিয়ে এলে যত বিষধর সাপই কাটুক না কেন, চিকিৎসায় রোগী সুস্থ হয়।

বগুড়া সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সামির হোসেন মিশু বলেন, সাপে কাটা রোগীরা সাধারণতঃ গ্রামাঞ্চলের হয়। সাপে কাটা রোগীদের যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতালে নিতে হবে, তারা যদি প্রয়োজন মনে করে তখন তারা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করতে পারেন।

তবে দেরি করা যাবে না। যেহেতু উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ সুবিধা নেই, তাই সঙ্কটাপন্ন রোগীদের উপজেলা হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে যদি আইসিইউ সুবিধাযুক্ত হাসপাতালে স্থানান্তর করে তখন সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে সেখানে নিতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির সভাপতি এম এ ফয়েজ সাপের দংশন ও এর চিকিৎসা নিয়ে বই লিখেছেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, গোখরো সাপের দংশনের গড় ৮ ঘন্টা পর, কেউটে সাপের দংশনের গড় ১৮ ঘণ্টা পর ও চন্দ্রবোড়া সাপের দংশনের গড় ৭২ ঘন্টা বা তিন দিন পর রোগীর মৃত্যু হতে পারে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সময়সীমার মধ্যে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা জরুরি। সাপের কামড় বা দংশনের পরে, দ্রুত অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন দিলে, অ্যান্টিভেনমের অ্যান্টিবডিগুলি বিষকে নিষ্ক্রিয় করে। যার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবন বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বেঁচে যায়। সাপে কামড়ানোর পর একজন রোগীকে ১০টি করে অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন দিতে হয়।

১০টি ভায়াল মিলে একটি ডোজ হয়ে থাকে। বিষের পরিমাণ এবং বিষাক্ততার মাত্রা বেশি হলে সাপে কামড়ানো ব্যক্তির উপর এক বা একাধিক ডোজ অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করার প্রয়োজন হতে পারে। চিকিৎসকরা মূলত রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে তার বিভিন্ন লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।

এসব লক্ষণের মধ্যে রয়েছে, শরীর অসাড় হয়ে যাওয়া, মাথা ঘোরানো, বুক ধরফর করা, শ্বাসকষ্ট, অসংগত ব্যবহার, ক্ষণিকের জন্য রক্তচাপ কমা। বিষধর সাপের অ্যান্টিভেনম সাপ ভেদে যেমন আলাদা হয়ে থাকে তেমনি একই অ্যান্টিভেনমে কয়েক ধরণের বিষধর সাপের বিষ নিষ্ক্রিয় করা যায়।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS