ভিডিও

দু’পক্ষের চলমান দ্বন্দ্ব আর সাংগঠনিক ব্যর্থতায় বিপর্যস্ত বগুড়া জেলা ছাত্রলীগ

এক বছরের কমিটি পার করেছে আঠারো মাস

প্রকাশিত: জুলাই ১০, ২০২৪, ১০:০৬ রাত
আপডেট: জুলাই ১১, ২০২৪, ১০:৩১ রাত
আমাদেরকে ফলো করুন

শাওন রহমান : ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর রাতে ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সজীব সাহাকে সভাপতি ও আল মাহিদুল ইসলাম জয়কে সাধারণ সম্পাদক করে বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের এক বছর মেয়াদী কমিটি গঠন করা হয়।

আংশিক ওই কমিটিতে ১৭ জনকে সহ-সভাপতি, পাঁচজনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ছয়জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ওই কমিটির মেয়াদ আট মাস আগে পেরিয়ে গেলেও এখনও পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি দিতে পারেনি সজিব-জয়। এমনকি জেলা ছাত্রলীগের অধীনে মোট কতটি ইউনিট আছে এবং এসব ইউনিটের বর্তমান অবস্থা কী, এর কোন তথ্যই দিতে পারেননি জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সজিব সাহা।

মূলত, সজিব ও জয়ের নেতৃত্বে কমিটি ঘোষণার পর পরই বগুড়ায় ছাত্রলীগের কমিটি বাতিলের দাবি তুলে পাঁচবার দলীয় কার্যালয়ে তালা লাগানো ও ভাঙা, আজিজুল হক কলেজে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ, ছুরিকাঘাত, দলীয় কার্যালয়ের সামনে অস্ত্র হাতে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ছাত্রলীগের কার্যালয়ের দরজা খুলে তাতে আগুন লাগানো ও দরজা খুলে নিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাতে স্থবির হয়ে পড়ে জেলা ছাত্রলীগের কার্যক্রম। দু’পক্ষের চলমান চরম দ্বন্দ্ব আর সাংগঠনিক ব্যর্থতায় বিপর্যস্ত জেলা ছাত্রলীগ।

জানা গেছে, ২০১৫ সালের ৭ মে বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সর্বশেষ বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১২ মে কেন্দ্র থেকে নাইমুর রাজ্জাক তিতাসকে সভাপতি ও অসীম কুমার রায়কে সাধারণ সম্পাদক করে পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর দেড় বছর পর ২০১৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর ১৫৭ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি পায় বগুড়া জেলা ছাত্রলীগ।

দীর্ঘ ছয় বছর পর ২০২২ সালের ২১ জানুয়ারি তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে মেয়াদোত্তীর্ণ তিতাস-অসীমের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। একই সাথে নতুন কমিটিতে সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক পদে আগ্রহী পদপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতৃবৃন্দের কাছে জীবনবৃত্তান্ত জমা দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়। এর ১১ দিন পর জেলা কমিটিতে নতুন করে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ পেতে বিভিন্ন পর্যায়ের অর্ধশতাধিক নেতা তাদের জীবনবৃত্তান্ত জমা দেন।

শহরের শহীদ টিটু মিলনায়তনে জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ ও মতবিনিময় সভার মাধ্যমে সেগুলো জমা নেয়া হয়। বিলুপ্ত হওয়ার প্রায় ১০ মাস পর ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর রাতে আল নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে সজীব সাহাকে সভাপতি ও আল মাহিদুল ইসলাম জয়কে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। সজিব সাহা জেলা ছাত্রলীগের আগের কমিটিতে গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক থাকলেও আল মাহিদুল ইসলাম জয় ছিলেন জেলায় একেবারে নতুন মুখ।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সম্মেলন ছাড়াই সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ ৩০ জনের নাম ঘোষণার পরপরই শহরের টেম্পল সড়কে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে জড়ো হন পদবঞ্চিত ও কাঙ্খিত পদ না পাওয়া নেতারা। ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সব সংগঠনের কার্যালয়ে বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা কমিটি প্রত্যাখ্যান করে ভবনের মূল ফটকে তালা লাগিয়ে দেন।

এরপর লাগাতার আন্দোলন ও বিক্ষোভ করেন পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা। তালা ঝুলিয়ে দিয়ে জেলা ছাত্রলীগের কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণও নেন তারা। দুই গ্রুপের বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতিতে দলীয় কার্যালয়ে তালা দেওয়া থেকে শুরু করে অস্ত্রবাজি, হামলা, অগ্নিসংযোগ, সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতাদের লাঞ্ছিত করার ঘটনাও ঘটে। কমিটি ঘোষণার দু’মাসে বগুড়ায় ছাত্রলীগের কমিটি বাতিলের দাবি তুলে পাঁচবার দলীয় কার্যালয়ে তালা লাগানো ও ভাঙার ঘটনা ঘটে।

এছাড়া আজিজুল হক কলেজে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ, ছুরিকাঘাত, দলীয় কার্যালয়ের সামনে অস্ত্র হাতে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ছাত্রলীগের কার্যালয়ের দরজা খুলে তাতে আগুন লাগানোর ঘটনাটও ঘটতে দেখা গেছে। ওই সময় বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের ৩০ সদস্যবিশিষ্ট আংশিক কমিটিতে স্থান পাওয়া কয়েকজন নেতা কমিটি বাতিলের আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। সংঘর্ষের ঘটনায় গত বছরের ১০ নভেম্বর ওই কমিটির সহ-সভাপতি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকসহ ছয় নেতাকে বহিস্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। যদিও পরে তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।

জানা যায়, প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে বগুড়া জেলা ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন জেলার প্রয়াত সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ উদ্দিন ও বতর্মান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম মোহন। এই দুই নেতার সুপারিশক্রমেই বিগত বছরগুলোতে বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ নির্ধারণ করতেন কেন্দ্রের নেতারা। তবে ২০২২ সালের কমিটি গঠনের আগে পরিস্থিতি ছিল কিছুটা ভিন্ন।

মমতাজ উদ্দিন মারা যাওয়ায় তার জায়গায় ছাত্রলীগের একটি পক্ষের নিয়ন্ত্রণ নেন বর্তমান সভাপতি মজিবর রহমান মজনু। অন্যপক্ষের নিয়ন্ত্রণ থাকে যথারীতি মঞ্জুরুল আলম মোহনের হাতেই। পদবঞ্চিতদের অভিযোগ ওই কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সম্পাদক পদ দু’টিই মজিবর রহমান মজনুর পছন্দের প্রার্থী পেয়ে যান। এতেই ক্ষিপ্ত হন মঞ্জুরুল আলম মোহন গ্রুপের নেতাকর্মীরা।

তাদের অভিযোগ ঘোষিত ওই কমিটি কোনো গ্রহণযোগ্য কমিটি নয়। এটা পকেট কমিটি। যাকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে সে ঢাকায় কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বগুড়া জেলা ছাত্রলীগে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এছাড়া যারা দীর্ঘদিন রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন তাদেরকে কমিটিতে রাখা হয়নি। তাদের দাবি, টাকা নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা আগ্রহণযোগ্য কমিটি দিয়েছেন।

এই কমিটি বাতিল করে নতুন করে যোগ্যদের নিয়ে কমিটি দেওয়ার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দেন তারা। ছাত্রলীগের ওই অংশের সাথে বেশকিছু জেলা আওয়ামী লীগ, সাবেক ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতারা একাত্মতা পোষণ করেন এবং দাবি আদায় না হয় পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানান।

দ্বন্দ্ব থাকলেও ওই আন্দোলন এখন অনেকটাই স্তিমিত। এক বছরের ‘প্রেস বিজ্ঞপ্তির ওই কমিটি’ পার করেছে এক বছর আট মাস। কমিটি বাতিলের আন্দোলনের মধ্যেই গত বছরের ২৮ এপ্রিল বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সজীব সাহা ও সাধারণ সম্পাদক আল মাহিদুল ইসলাম জয় স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের লক্ষ্যে পদ প্রত্যাশীদের কাছে জীবন-বৃত্তান্ত চাওয়া হয়।

জেলা ছাত্রলীগের কার্যনির্বাহী কমিটির এক সভায় পূর্ণাঙ্গ কমিটির পদ প্রত্যাশীদের ২৯ এপ্রিল থেকে ৩ মে’র মধ্যে বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরাবর জীবন বৃত্তান্ত জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে এখন পর্যন্ত পুর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেনি সজিব-জয়।

এমনকি জেলা ছাত্রলীগের আওতায় যে ২১টি ইউনিট কমিটির প্রায় সবক’টিরই মেয়াদ শেষ হয়েছে কয়েক বছর আগে, অস্তিত্ব নেই অনেক ইউনিটের। সজিব-জয় শুধু দু’একটি কমিটি গঠন ও কিছু কমিটির নেতৃত্বকে অব্যহতি ও নতুন দায়িত্ব দিয়েছেন। বিগত ১৮ মাসে জেলা আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ ছাড়া কোন সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেখা যায়নি এই দুই নেতাকে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সজীব সাহা বলেন, জেলা ছাত্রলীগের পুর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে পুর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে। জেলা ছাত্রলীগের অধীনে কতটি ইউনিট আছে জানতে চাইলে তিনি তথ্য নেই জানিয়ে পরে ফোন দিতে বলেন। প্রায় তিন ঘন্টা পর ফোন দিলে তিনি ইউনিটগুলো ব্যাপারে কোন মন্তব্য করবেন না বলে জানান।

এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, যেসব জেলায় পুর্ণাঙ্গ কমিটি নেই সেসব জেলা নেতৃবৃন্দকে পুর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বগুড়া জেলা কমিটির মেয়াদ আট মাস আগেই শেষ হয়েছে জানালে তিনি বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ সকল কমিটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সম্মেলনের মাধ্যমে গঠন করা হবে।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS