ভিডিও

দেয়ালে দেয়ালে বৈষম্যের প্রতিবাদ, আশার দিশা

প্রকাশিত: আগস্ট ১৮, ২০২৪, ১১:১২ রাত
আপডেট: আগস্ট ১৮, ২০২৪, ১১:১২ রাত
আমাদেরকে ফলো করুন

নাসিমা সুলতানা ছুটু : ‘শোন মহাজন-আমরা কিন্ত অনেকজন’, ‘আমি খোলা জানালা’, ‘মেয়েরা মায়েরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা’, ‘এ দেশে ভাস্কর্য থাকবে, সংস্কৃতি থাকবে, ধর্ম থাকবে, থাকবে না শুধু অন্যায় অবিচার’ বগুড়া সার্কিট হাউসের রোড ধরে যেতে বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, পুলিশ অফিস, পৌরসভার দেয়ালে এভাবেই প্রতিবাদের ভাষা লিখেছেন শিক্ষার্থীরা।

শুধু ওই দেয়ালেই নয়। একটু এগিয়ে খোকন পার্কের গেটের সম্মুখ দিয়ে জিলা স্কুলে ঢোকার সময়ই চোখে পড়ে ক্যালিগ্রাফি ও শহীদ আবু সাঈদকে নিয়ে কালো রঙের ওপর নানান রঙের মিশেলে একটা দেয়ালচিত্র বা গ্রাফিতি। শুধু আবু সাঈদই নয়, পানির বোতল হাতে মুগ্ধ’র ছবি। পাশে লেখা ‘পানি লাগবে কারো পানি’।

বগুড়ার জিরো পয়েন্ট সাতমাথা ও এর পাশে প্রতিষ্ঠিত শুধু ওই দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নয়, শহরের প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেয়ালসহ অন্যান্য দেয়ালগুলোতে রয়েছে এমন হাজারো প্রতিবাদের ভাষা। এমন অসাম্প্রদায়িক নান্দনিকতার মিশেলে দেয়ালচিত্র দেখেছে কখনও বাংলাদেশ? যেখানে রং-তুলির ছোঁয়ায় নিজের দাবি ফুটিয়ে তোলার স্বাধীনতা পাওয়া যাবে? নাহ্, ২০২৪ এর জুলাইয়ের আগে এমন বাংলাদেশ কখনও দেখেনি কেউ। যেখানে শিক্ষার্থীরা দেয়ালকেই বেছে নিয়েছে একমাত্র তাদের প্রতিবাদের ভাষা প্রকাশের জন্য।  
২০১৮’র পর সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ২০২৪ সালের এক পর্যায়ে চারদিকে মরদেহের স্তূপের মাঝে একদল তরুণ রং-তুলি, পেইন্ট স্প্রে নিয়ে ঢাকা, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম বগুড়াসহ  সারাদেশের বিভিন্ন দেয়ালে গ্রাফিতি এঁকে রাঙিয়ে তুলে প্রাণ সংশয়ের ভয় নিয়ে।

সেই গ্রাফিতিগুলোতে উঠে আসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ থেকে শুরু করে নিহত সব শিক্ষার্থীর হত্যার বিচারের দাবির কথা। শিক্ষার্থীরা ২৬ জুলাই গ্রাফিতির মাধ্যমে দেয়ালে দেয়ালে প্রতিবাদের ঘোষনা দিলেও ২৭ জুলাই খুবই সীমিত আকারে দেয়ালে প্রতিবাদ জানানো হয়।

গতকাল দুপুরের দিকে বগুড়া জিলা স্কুলে বগুড়া জিলা স্কুলে ঢুকতেই পূর্ব পাশের দেয়ালে চোখ আটকে গেল। সেখানে দশ-বারো জন তরুণ-তরুণী স্কুলের  দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকছেন।

ওই দেয়ালের গ্রাফিতি আঁকিয়েদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ঢাকার এআইইউবি’র (আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি অব বাংলাদেশ) আর্কিটেক্ট বিভাগের শিক্ষার্থী রিসাদ, জাহাঙ্গীরনগর ইউনির্ভাসিটির শাফি, ইউল্যাব ইউনির্ভাসিটির নাহিদ, ব্র্যাক ইউনির্ভাসিটির জায়েদ, ড্যাফোডিল ইউনির্ভাসিটির আলফাজ এবং ইশতিয়াক।

রিসাদ বলেন, ‘বগুড়া  শহরে আমরা এমন একটি দেয়াল খুঁজছিলাম, যেখানে এই আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ ৭ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত পুরো চিত্রটাই ফুটে তুলবো। সেটার জন্য আমাদের কাছে এই দেয়ালটিকেই উপযুক্ত মনে হয়েছে।

এই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে গত ১৫ আগস্ট থেকে গ্রাফিতি শুরু করেছি। এই গ্রাফিতিতে আন্দোলনের শুরু ঢাকা ভার্সিটি থেকে দেশের অন্যান্য পাবলিক ও প্রাইভেট ভার্সিটি, শহীদ আবু সাঈদকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে সেটি, মুগ্ধসহ অন্যান্য শহীদরা থাকবে, রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে সব শ্রেণির মানুষের প্রতিবাদ এবং শেষে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিমানে করে দেশ ত্যাগও উঠে আসবে।

আজ রোববার (১৮ আগস্ট) যদি শেষ না হয় তবে আগামিকালের মধ্যে আমাদের এই গ্রাফিতি শেষ হবে’। রিসাদ আরও বলেন, ‘২৬ জুলাই ঘোষণার পর ২৭ জুলাই থেকে আমরা দেয়ালে গ্রাফিতি শুরু করি। তবে সে সময় পুলিশ এবং র‌্যাবের ভয়ে ভোরবেলা আমরা গ্রাফিতি করতাম। প্রথম আমরা বগুড়া স্টেশন রোডে শুরু করি। আমরা জানতাম, এত ভোরবেলা পুলিশ বের হবে না, এজন্য আমরা ওই সময়টাকেই বেছে নিয়েছিলাম।

উপ-শহরে বিয়াম পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বিয়াম স্কুলের দেয়ালের দিকে মুখ ফেরালেই দেখা মেলে স্প্রে, পেইন্টের রঙে রঙিন কাঁচাপাকা হাতের গ্রাফিতি। আবু সাঈদের মায়ের আহাজারি ‘হামার বেটাক মারলি কেনে?’, মুগ্ধর পানির কেস হাতে ‘এই পানি লাগবে পানি’, ‘রক্তাক্ত জুলাই’, ‘দেশটা কারও বাপের না’, ‘গেরিলা বসন্তে আমরাই বুনোফুল’, ‘ধর্ম যার যার, দেশ সবার’, ‘সংস্কার, বিকল্প কে?’ এমন হাজারো প্রতিবাদী শ্লোগান ও তরুণ প্রজন্মের দাবি উঠে আসে গ্রাফিতি আকারে।

পুলিশ দিয়ে গ্রাফিতি আঁকার সময় শিক্ষার্থীদের বাধা দেওয়া হয়। তবুও শিক্ষার্থীরা দমে যায়নি। তারা চুপিসারে গ্রাফিতি এঁকে প্রতিবাদ করে। ৫ আগস্ট সরকার পতন হয়। এরপর হঠাৎ করেই যেন আন্দোলনের সময়ে আঁকা গ্রাফিতি, পোস্টারে ভরে থাকা দেয়াল, পিলার, সড়ক বিভাজক, বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, প্রধান সড়কের দেয়াল পাল্টে যেতে থাকে।

বিভিন্ন রঙে রঙিন হতে থাকে। ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সহায়তায় প্রতিবাদী তরুণরা যা যা চায় এবং মনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে গেছে দেয়ালে দেয়ালে রং-তুলি দিয়ে। এখনও তারা থেমে নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিলেও এখনও কিছু কিছু শিক্ষার্থী এমন প্রতিবাদের ভাষা গ্রাফিতিতে আঁকিয়েই যাচ্ছে।

বেলা আড়াইটা। পনেরো থেকে কুড়িজনের একদল কিশোর-কিশোরী উপশহরের বিয়াম ফাউন্ডেশনের বিপরীত পাশে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের দেয়ালের দিকে মুখ ফিরে আছে। তাদের হাতে স্প্রে, ব্রাশ ও রঙের  কৌটা। কারো পরনে স্কুলের পোশাক তো কেউ আছে ক্যাজুয়াল পোশাকে।

একটু সরতেই চোখে পড়লো পলেস্তার উঠে যাওয়া স্যাঁতসেতে দেয়ালটিকে রঙ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পলকের ছবি। পাশে লেখা রয়েছে ‘শেখ হাসিনার স্যাটেলাইটে পানি ঢুকেছিল’। পাশের দেয়ালটিকে আকাশী ও সবুজ রঙ করে কালো কালি দিয়ে লেখা হয়েছে, পলকে পলকে, নাটক কম পিও, জেন জেড, হাউন আঙ্কেলসহ নানা প্রতিবাদ।

কিশোর-কিশোরীদের দল থেকে এগিয়ে এসে শাইক, মেধা, সাফাসহ কয়েকজন জানায়, বগুড়া আর্মড ব্যাটালিয়ন পাবলিক স্কুলের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী ওরা। ‘ ক্লাস তো শুরু হয়েছে, তোমরা করছো না’ বলতেই ওরা সমস্বরে বলে ওঠে, আমরা স্কুলে গিয়ে শ্রেণি শিক্ষককে বলে আজ ছুটি নিয়ে এসেছি। কারণ এই দেয়ালে আমরা পরশু গ্রাফিতি শুরু করেছি। কাল এসে বৃষ্টির কারণে ফিরে গিয়েছি। আজ শেষ করবো। কাল থেকে আমরা ঠিকঠাকমত স্কুল করবো’।

‘শোনো মহাজন, আমি নয়তো একজন, শোনো মহাজন, আমরা অনেকজন’,  ‘রংতুলির রং এ আঁকা শিল্পীর যত চাওয়া ক্যানভাসে বিজয়ের খোঁচা যা মুক্তিকামীর চাওয়া,’ ‘আমরাই পারি তারুণ্যের বিজয় ছিনিয়ে আনতে’, ‘ধর্ম যার যার দেশটা সবার’, এমন প্রতিবাদী শতাধিক ছবি ও লেখার গ্রাফিতিতে ভরে গেছে বগুড়া করতোয়া মাল্টিমিডিয়া স্কুল এ্যান্ড কলেজের দেয়াল।

সরকারি আজিজুল হক কলেজের দক্ষিণের গেটের সম্মুখে দাঁড়ালেই চোখে পড়ছে লাল, সবুজ, হলুদ, কালোসহ নানান রঙে আঁকা গ্রাফিতি। ওই স্কুলের ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী আয়েশা নুসরাত নিশা ও কোহিনুর আফরোজ জানায়, কয়েকদিন আগে বেশ কিছু শিক্ষার্থী মিলে এই গ্রাফিতি আঁকিয়েছে।

বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দেয়ালে সাদা রঙের উপর লাল রঙের মাঝে হলুদ সূর্য এবং তার পাশেই বিজয় পতাকা হাতে শিক্ষার্থীদের উল্লাস। হলুদ সূর্যের মাঝে কালো কালি দিয়ে লেখা রয়েছে ‘গর্জে উঠেছিলাম বলেই বিজয় এসেছিল’। পাশের দেয়ালের গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে গাছের ডালে পাখির খাঁচা। খাঁচা থেকে পাখিরা উড়ে যাচ্ছে।

পাশে লাল কালি দিয়ে লেখা রয়েছে ‘যে পথ আমার সত্যের বিরোধী, সে পথ ছাড়া কোনো পথই আমার বিপথ নয়’ এমন বেশ কিছু প্রতিবাদের গ্রাফিতি। গ্রাফিতি আঁকানোতে অংশ নেওয়াদের মধ্যে ওই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মনিরা ও শামিমা নাসরিন জানায়, আমরা ১৬ জুলাইয়ের আগে বুঝতে পারিনি আমরা দেশকে কতটা ভালোবাসি।

১৬ জুলাই যখন রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ ভাইয়াকে গুলি করে হত্যা করা হয়, তারপর আমরা ভাবলাম, এই দেশ আমাদের নয়। যে দেশে পুলিশ প্রকাশ্যে এভাবে গুলি করে শিক্ষার্থী হত্যা করে, সেটা আমাদের হতে পারে না। দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করতে হবে। দেশকে নতুন করে স্বাধীন করতে হবে। তারপর থেকে আমরা আন্দোলনে নেমে পড়ি।

৫ আগস্ট সরকার পতনের পর গ্রাফিতি আঁকা থেকে যত কর্মসুচি আছে সবগুলোতে অংশ নিয়েছি। শুধু বগুড়া নয়, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি শহরে দেয়ালচিত্র এঁকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের সময়ের বিভিন্ন স্মৃতি তুলে ধরছে দেয়ালে।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের আগে থেকেই একটি শব্দের সঙ্গে পরিচিত, সেটি হলো দেয়ালে ‘চিকা মারা’। চিকা মারাকে প্রতিবাদী দেয়াল লিখন বোঝাতো। বিভিন্ন প্রতিবাদী ভাষা চুপিসারে দেয়ালে লুকিয়ে লেখা হতো তখন। দেয়ালে চিকা মারার মধ্যে ‘আইজুদ্দিন’ ও ‘সুবোধ’ অনেক বেশি জনপ্রিয়। এই দুটো চরিত্র এক বা দুই শব্দে অনেক অধিকার ও দাবির কথাই বলে দিত আমাদের।

সেই চিকা মারা থেকে প্রথানুযায়ী শিল্পমাধ্যম না হওয়া সত্ত্বেও গ্রাফিতি বর্তমানে প্রতিবাদের একটি অন্যতম ভাষা হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রং-তুলিকে প্রতিবাদী ভাষার মাধ্যম হিসেবে নিয়েছে শিক্ষার্থীরা। যেখানে স্পষ্টভাবে মনের ক্ষোভ তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে কোনো রাখঢাক নেই। প্রথানুযায়ী শিল্পমাধ্যম না হওয়া সত্ত্বেও গ্রাফিতি বর্তমানে সারাবিশ্বে প্রতিবাদের অন্যতম ভাষা হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে।

শিক্ষার্থীরা রং-তুলি হাতে নিয়ে স্বাধীনভাবে যে দেয়ালগুলোতে প্রতিবাদী ভাষায় নিজেদের অধিকার চেয়েছিল, সেই দেয়ালগুলো আবার স্মৃতির রঙিন ডায়েরির মতো করে সাজিয়ে তুলছে বিভিন্ন শৈল্পিক গ্রাফিতি ও ক্যালিগ্রাফির মধ্য দিয়ে।

তারা বলছে, ‘আমাদেরই দেশ এটা। প্রতিবাদ করার ভাষা প্রকাশের ক্যানভাস হিসেবে যে দেয়ালগুলো রাঙিয়েছিলাম আমরা, সেগুলোতে এখন নিহতদের শ্রদ্ধা ও ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের কথা এঁকে রাখতে চাই।’



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS