ভিডিও

স্বামীর উপহার বনসাই দিয়েই শুরু

মৌসুমীর কংক্রিটের পুরো ছাদটাই হাজারও ফল-ফুলের বিশাল জমিন

প্রকাশিত: জুলাই ০৪, ২০২৪, ০৯:০৯ রাত
আপডেট: জুলাই ০৫, ২০২৪, ০৫:৫৪ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

নাসিমা সুলতানা ছুটু : মৌসুমীর ইট-বালু, সিমেন্টের তৈরি ছাদটাই যেন এক খন্ড জমি। কী নেই সেখানে? আম, জাম, লিচু, পেয়ারা, আপেল, আঙ্গুর, কমলা, মাল্টা, শিম, লাউ, বরবটি, করলা, ডাঁটা, গোলাপ, গাঁদা, জবাসহ দেড় শতাধিক দেশি-বিদেশি নানা ফল, ফুল ও সবজি। বাদ যায়নি অ্যাভোকেডো,জয়তুন ও ত্বীনের মত দামি ফল, কফির গাছ, নানা জাতের ঔষধি গাছসহ বনসাই। কংক্রিটের তৈরি পুরো ছাদটাই এক বিশাল সবুজের সমারহ। বিষমুক্ত ও টাট্কা এসব ফলমূল, সবজি ও ফুলের এই বাগান দেখলে শুধু চোখই নয় হৃদয়ও জুড়ে যায় যে কোন দর্শনার্থীর।

বগুড়া শহরের মালতিনগর এলাকায় প্রায় ৩ হাজার বর্গফুটের এই ছাদ বাগানটি একটু একটু করে গড়ে তুলেছেন মৌসুমী আক্তার। পেশায় শিক্ষক হলেও বাগান করা তার প্যাশন। ছোটবেলায় শিক্ষক বাবার কাছ থেকেই শিখেছেন গাছকে ভালোবাসতে ও গাছের যত্ন নিতে। বগুড়ার ফয়েজুল্বা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মৌসুমীর শৈশব-কৈশোর ও তারুন্যের বড় একটি অংশ কেটেছে মফস্বলে। বগুড়ার ধুনট উপজেলায় তার জন্ম। সেখানেই প্রাইমারী থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। এরপর বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে প্রাণীবিদ্যায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন মৌসুমী।

মৌসুমী বলেন, শৈশবেই গাছের প্রতি আমার ভালোবাসা জন্মে। বাবা ছিলেন পার্শবর্তী উপজেলা সারিয়াকান্দির পাইলট গার্লস হাই  স্কুলের প্রধান শিক্ষক। স্কুল থেকে এসেই উনি গাছের পরিচর্যা করতেন। তার সঙ্গে সঙ্গে আমিও থাকতাম। দেখতাম বাবা কীভাবে গাছের যত্ন নেন। তার দেখে আমিও বাবার মত গাছের যত্ন নিতাম। বাবা সব সময় চাইতেন, তার সন্তানদের বিষমুক্ত ফলমূল ও সবজি খাওয়াবেন। এজন্য নিজের হাতেই গাছের পরিচর্যা করতেন। বাবাকে দেখতাম সন্তানদের মতই গাছের যত্ন নিতেন। তিনি বলেন, অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পর ২০০৫ সালে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর শ^শুর বাড়ি যখন আসি তখন বিশালাকার ছাদ দেখে খুব খুশি হই। তখনই ভেবে নেই এই ছাদেই আমি সবুজ ফলাবো, গড়ে তুলবো সবুজের সমাহার। শৌখিন এই বৃক্ষ প্রেমি এতদিন শখের বসে বাগান করলেও আগামি বছর থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আঙ্গুর চাষ করবেন বলে জানান।

বিয়ের পর ওই বছরই মৌসুমীর স্বামী তাকে একটি বনসাই উপহার দেন। তখন থেকেই শুরু তার ছাদ বাগান করার। প্রথম দিকে শুধু কিছু ফুল, ক্যাকটাস, পাতা বাহার বাগানে রাখলেও ২০১২ সাল থেকে সবজি ও ফলমূল চাষ করা শুরু করেন। বর্তমানে তার বাগানে আম, জাম, লিচু, বেদেনা, পেয়ারা, পেঁপে, আপেল, আঙ্গুর, অ্যাভোকোডা, ড্রাগন, ত্বীন, কফি বীন, আলু বোখারাসহ প্রায় ত্রিশ থেকে চল্লিশ প্রকারের ফল রয়েছে। লাউ, পুুঁই, ডাটা, ঢেঁড়শ, করলা, তরী, কদর, টমোটো, ঝিঙ্গেসহ সব ধরনের মৌসুমী শাক-সবজি রয়েছে। গোলাপ, জবা, জুঁই, চ্যামেলি, বেলিসহ অনেক রকমের ফুল শোভা পাচ্ছে তার বাগানে। জয়তুন, তুলসী, পুদিনা পাতাসহ বেশ কয়েক ধরনের ঔষধি গাছ রয়েছে। এছাড়া রাঁধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া, বট পাকুরের কয়েকটি বনসাইও আছে তার ছাদ বাগানে। মৌসুমী জানান, বর্তমানে তার বাগানে ১৭/১৮ রকমের দেশি-বিদেশি গোলাপ এবং ২০/২২ রকমের জবা ফুলের গাছ রয়েছে। ভ্যানিলা মৌসুমীর আগামী বছরের চমক। যে  ভ্যানিলা বীন থেকে কেক এর ভ্যানিলা এসেন্স তৈরি হয়। এই বছর সেই চারাটিও তিনি রোপণ করেছেন। বাগান করতে গিয়ে ভাঙ্গা হাড়ি-পাতিল, গোসলের মগ, বেসিন, সিঙ্ক, কমোডের ফ্ল্যাশসহ সংসারের কাজে পরিত্যক্ত কোন কিছুই ফেলে না দিয়ে তিনি ছাদ বাগানের অনুসঙ্গ হিসেবে কাজে লাগান। এছাড়া টব, জিও ব্যাগ, আধা ড্রাম এবং ইট বিছিয়ে ছাদে বেড করা তো রয়েছেই। আর বাগানের জন্য চারা সংগ্রহ করেন বিশ্বস্ত বিভিন্ন অনলাইন পেজ, পরিচিত স্বজন বা বন্ধু, স্থানীয় নার্সারি থেকে। এছাড়া যখন যেখানে বেড়াতে যান সেখানেও ভালোজাতের কোন ফল, ফুল বা সবজির সন্ধান পেলে সেখান থেকেও চারা সংগ্রহের চেষ্টা করেন।

সৌখিন এই বৃক্ষ প্রেমিক করোনার সময় অনলাইন ফুড বিক্রেতা হিসেবেও বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন বলে জানান। মৌসুমী বলেন, করোনা সময় স্কুল বন্ধ ছিলো তাই অগাধ সময় পেতাম। সেই সময়টাকে কাজে লাগানোর জন্য কেকসহ বিভিন্ন হোমমেড খাবার তৈরি করে বিক্রি করা শুরু করি। বাচ্চাদের বাইরের ভেজাল খাবার খাওয়াবো না বলে বিভিন্ন সময় খাবারের বিভিন্ন আইটেমের উপর অনলাইন কোর্স করি। সেটি করোনার সময় কাজে লাগে। তখন সেসব খাবার তৈরি করে বিক্রি করতাম। লকডাউন উঠে যাওয়ার পর আর সময় পাই না।

মৌসুমী ছাদ বাগান করার পাশাপাশি বেশ কিছু সমাজসেবা মূলক কাজের সাথেও জড়িত রয়েছেন। "আমরা ধুনট বাসী সংগঠন " নামে ওই সংগঠনের পক্ষ থেকে কয়েক বছর যাবৎ ধুনটের বিভিন্ন পথে তালবীজ রোপণসহ অনেক গাছ রোপণ করে আসছেন। ‘আমে সমৃদ্ধ ধুনট গড়ব’ এই শ্লোগান নিয়ে এবছর প্রায় ৩৫০০ উন্নত জাতের কলমের আমের চারা রোপন করেছেন। সেই সাথে নিম ও জামের চারাও রোপন করেছেন। মৌসুমী বলেন, আমাদের মত কিছু ধুনটের সন্তান যারা চাকরি বা সংসারের সুবাদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকি কিন্তু  নিজেদের প্রচেষ্টায় মনে প্রাণে  সবুজ শ্যামল, শিক্ষা ও সভ্যতায় সমৃদ্ধ ধুনট গড়তে চাই। তারাই মূলত এই সংগঠনের সদস্য। নিজেদের পকেটের পয়সা খরচ করেই আমরা সংগঠনটি চালাই। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে গাছ লাগাই, গরীব মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য আর্থিকভাবে সহায়তা করা হয়।

শিক্ষক হিসেবেও মৌসুমী আক্তার বেশ সুনাম অর্জন করেছেন। 

মৌসুমী আক্তার নিজের সময়কে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে নিয়েছেন। এরমধ্যে রয়েছে প্রতিদিন বাগানে পানি দেওয়া, নিজের পেশা, সংসার দেখা এবং তার তিন কন্যা ও স্বামীর যত্ন নেওয়া। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষবাদ করার পরিকল্পনা রয়েছে কী না জানতে চাইলে মৌসুমী বলেন, হুম ইচ্ছে আছে। এ বছরই শেষের দিকে তিনি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আঙ্গুরের চাষ করবেন। এজন্য শহরের ভাটকান্দি এলাকায় তিনি জমি কিনেছেন এবং সুমিষ্ট ভালো জাতের আঙ্গুরের চারার সন্ধানও পেয়েছেন। অনেক বছর থেকে ভালো জাতের আঙ্গুরের চারা লাগানোর চেষ্টা করলেও কোনভাবে পাচ্ছিলেন না। কিন্তু গত বছর তিনি ভালো চারার সন্ধান পেয়েছেন। ইতোমধ্যে ওই চারা থেকে আঙ্গুর ফলিয়ে সন্তানদের খাইয়েছেনও। তিনি বলেন, আমরা বাজারে যে ফলগুলো কিনি সেগুলো মূলত ফরমালিনযুক্ত। এছাড়া ওগুলো আবেদ করতে প্রচুর পরিমানে রাসায়নিক সার মেশানো হয়। যা শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এখন অনেক সচেতন ক্রেতাই চান ফরমালিন ও বিষমুক্ত সবজি ও ফলমূল। তাদের কথা ভেবেই আপাততঃ শুধু আঙ্গুরের চাষ করবো। বাকিটা পরে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানাতে গিয়ে মৌসুমী বলেন, কৃষিকে আমি এতটাই ভালোবাসি যে ভবিষ্যতে কৃষি নিয়েই কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে। এজন্য আমি আরও ভালোভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য নতুন করে আবারও পড়ালেখা শুরু করেছেন। তিনি টেকসই কৃষির উপর মাস্টার্স করছেন। মাস্টার্স অব সাসটেইনেবল এগ্রিকালচার এন্ড রুর‌্যাল লাইফলি হুড (এমএসএআরএল) এই বিষয়ে ভর্তি হয়েছি। এরইমাঝে এক বছর পেরিয়ে গেছে। আর এক বছর পর শেষ হবে। পড়ালেখা শেষে কৃষি বিষয়ক পরামর্শ দেওয়াসহ নিজের বৃহৎ পরিসরে কৃষি নিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছে রয়েছে।

ব্যক্তিগত জীবনে মৌসুমী তিন কন্যা সন্তানের জননী। বড় মেয়ে দশম শ্রেণিতে আর ছোট দুটি প্রাইমারী শাখায় রয়েছে। তার স্বামী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন। আগে বাবার কাছে যেমন বাগান করার জন্য যেমন সহযোগিতা পেয়েছেন বিয়ের পর স্বামীসহ সন্তানরা ও শিক্ষার্থীরা তাকে সহযোগিতা করেন বলে জানান। মৌসুমী বলেন, শিক্ষকতা পেশাটাকে আমি যেমন ভালোবাসি তেমন বাগান করাটাও আমার ভালোবাসার আরেক স্থান। দুটো নিয়েই আমি পূর্ণ। প্যাশন এবং পেশা দুটোর একটি ছাড়া আমি সত্যিই অপূর্ণ।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS