ভিডিও

শেগুফতার গল্পটা সিনেমার নয়, তবে বাস্তব 

প্রকাশিত: আগস্ট ৩০, ২০২৪, ০৫:৪৩ বিকাল
আপডেট: আগস্ট ৩০, ২০২৪, ০৫:৪৩ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

নিজের আলোয় ডেস্ক ঃ বাবা ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক। ২০০৬ সালে একই বিভাগের আরেক সহকর্মী মিয়া মেহাম্মদ মহিউদ্দিন থিসিস পেপার নকল করার অভিযুক্ত হওয়ায় অধ্যাপক হতে না পারার আশঙ্কায় তার বাবাকে খুন করে ফেলে। মামলা হয়েছে কিন্তু বিচার প্রক্রিয়ায় কোনো অগ্রগতি দেখছেন না, বড় ভাই একাই লড়েছেন।

এর মাঝে জানতে পারেন, খুনিরা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। শেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে পড়ছেন। বাবার খুনিদের বিচার নিশ্চিত করতে নিজের ক্যারিয়ারের লক্ষ্য পরিবর্তন করে আইনজীবী পেশায় যুক্ত হন। আইন বিভাগে পড়াশোনা করা অবস্থায় ৭ বছর তারপর আরও ৯ বছর, মোট ১৬ বছর লড়াই করে বাবার খুনিদের বিচার নিশ্চিত করেছেন। উচ্চ আদালত আসামির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রিভিউ শেষে চূড়ান্ত রায় দিয়েছে ৪ আসামীর ২ জনের ফাঁসি, ২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এখন শুধু রায় কার্যকরের অপেক্ষা। 

ঘটনার শুরু যেখান থেকে: পরিবারের সাথে একাডেমিক ছুটি কাটিয়ে ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ কোয়ার্টারে ফেরেন অধ্যাপক ড. এস তাহের। উদ্দেশ্য ২ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক নির্বাচন কমিটিতে যোগ দেওয়া। এরমধ্যে ১ তারিখ পেরিয়ে ২ তারিখ সারাদিন চলে গেল, বাবার কোনো খোঁজখবর না পেয়ে অফিস থেকে বাসায় ফিরে ঐদিন রাত বারোটায় বাবার খোঁজ নিতে রাজশাহীতে ছুটে যান একমাত্র ছেলে সানজিদ আলভি আহমেদ। কোয়ার্টারে বাসার দরজায় অনেকক্ষণ নক করার পর কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দেখেন বাবা নেই বাসায়।

এরপর একই ভবনের দোতালায় গিয়ে দেখেন বাবার পরিহিত প্যান্ট পরে আছে মেঝেতে। তখন বুঝতে পারেন কিছু একটা ঘটেছে। এরমধ্যে পুলিশ আসে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন আসে, সবাই মিলে ভোর সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারের ম্যানহোল থেকে ড. এস তাহেরের লাশ উদ্ধার করেন। কিন্তু তখনও এ খবর জানানো হয়নি ঢাকায় অবস্থানরত মা এবং বোনকে। খবর বেশিক্ষণ চাপা রইল না, টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে ড. এস তাহেরের খুনের সে সংবাদ পৌঁছে যায় ঢাকায় অবস্থানরত কন্যা এবং স্ত্রীর কাছে। 

থিসিস নকলের প্রতিবাদই হলো কাল ঃ ২ তারিখে অধ্যাপক নিবার্চনে প্রার্থীদের মধ্যে একজন ছিলেন ড. এস তাহেরের একসময়ের ছাত্র পরবর্তীতে তার সহকর্মী মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। মহিউদ্দিনের সাথে তাহেরের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। নিয়মিত বাসায় আসা-যাওয়া হতো তাদের। অধ্যাপক নির্বাচনের সপ্তাহখানেক আগে মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে থিসিস পেপার নকল করার অভিযোগ আনা হয় এবং প্রাথমিকভাবে তার সত্যতাও মিললে আগে থেকেই ড. এস তাহের এই নিয়ে তার অবস্থান জানিয়ে দেয়, কোনো অবস্থানে তিনি প্লেজিয়ারিজম করা কাউকে অধ্যাপক প্রমোশনে সুপারিশ করবেন না।

এই থেকে শুরু হলো তাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি। সেইদিন মহিউদ্দিন এক প্রকার নিশ্চিত হয়ে যান বোর্ডে ড. এস তাহের থাকলে তার অধ্যাপক হওয়ার পথে বাঁধা হবে। তাই সিদ্ধান্ত নেয় ২ তারিখের আগেই ড. এস তাহেরকে খুন করার। এরমধ্যে তাহেরের বাসার কেয়ারটেকার মো. জাহাঙ্গীর আলমের সাথে টাকার বিনিময়ে আঁতাত করে ফন্দি আঁটেন ছুটি কাটিয়ে ড. এস তাহের রাজশাহী ফিরলে বাসায় ঢুকার আগেই তাকে খুন করে লাশ ম্যানহোলে ফেলে দিবেন। এবং করলেনও সেই ধিকৃত কাজ।

বিচার নিশ্চিত করতে মেয়ের আইনজীবী হওয়া: শেষ দিকে তাহেরের সাথে সম্পর্কের অবনতি এবং মহিউদ্দিনের থিসিস নকলের প্রতিবাদ বিষয়গুলো আমলে নিয়ে মতিহার থানায় তাহেরের ছেলের করা অজ্ঞাতনামা মামলায় মহিউদ্দিনকে গ্রেফতার করলে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।

পুলিশ গ্রেফতার করেন খুনের সাথে জড়িত অন্য আসামীদের। মামলা চলতে লাগল ধীরগতিতে, একাই সব সামাল দিতে হচ্ছে ছেলে সানজিদকে। একদিকে তার নতুন চাকরি তারমধ্যে বাবার খুনের পর মা-বোনের দায়িত্ব এসে পরে তার কাঁধে, অন্যদিকে এই মামলার নথিপত্র জোগাড় করা সবমিলিয়ে পরিস্থিতি বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে তার জন্য। এরমধ্যে একদিন অফিস থেকে ফিরে সানজিদ বাসায় জানান খুনিরা সব ক্ষমতার বলে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। খুনি মহিউদ্দিনের শ্যালক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। ১০ জন বিজ্ঞ আইনজীবী লড়ছে তার পক্ষে।

সেগুফতা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে পড়ছেন। বাবার খুনিরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে এমন সংবাদ অল্প বয়সেই তার মাথায় দুশ্চিন্তার ভাজ পড়ে গেল! বছরখানেক আগে বাবা তাকে আইনে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। আইনে ভর্তি হলেও ভবিষ্যতে আদালত অঙ্গনে কাজ করার ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও পরিস্থিতির শিকার হয়ে বাবার খুনিদের বিচার নিশ্চিত করতে সে নিজের জীবনের লক্ষ্য পরিবর্তন করে আইনজীবী হিসেবে ক্যারিয়ার গড়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই শুরু হয় তার লড়াই। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে ছায়ার মতো লেগে ছিলেন এ মামলার সকল তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে। রাষ্ট্রপক্ষের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ নথি ও তথ্য সরবরাহ করেছেন। সার্বক্ষণিক এই মামলার তদারকি করে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অবশেষে সর্বোচ্চ আদালত থেকে চূড়ান্ত রায়ে খুনিদের শাস্তি নিশ্চিত করেছেন। পড়াশোনা করা অবস্থায় ৭ বছর তারপর আইনজীবী হয়ে আরও ৯ বছর, মোট ১৬ বছর বাবার খুনের এই এক মামলার পিছনেই নিজের পুরো সময় সঁপে দিয়েছিলেন শেগুফ্তা। শুনতে হয়েছে নানা কটূক্তি, তারপরও দমে যাননি।

এখন শুধু রায় কার্যকরের অপেক্ষা ঃ রাজশাহীর দ্রুত বিচার আদালতের ৬ আসামির ৪ জনকে ফাঁসি এবং ২ জনকে বেকসুর খালাস রায়ে আসামি পক্ষের আপিল করা হলে মামলা এসে পড়ে হাইকোর্ট। পরবর্তী ২০১৩ সালে হাইকোর্ট ৪ আসামির ২ জনকে ফাঁসি এবং ২ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেয়। নিয়ম অনুসারে মামলার ডেথ রেফারেন্স সংগ্রহে আদালত একই সাজা বহাল রাখে। তারপর আসামি পক্ষ আবারও আপিল করলে গত বছর উচ্চ আদালত ২ জনকে অর্থাৎ মহিউদ্দিন এবং তার কাজে সহযোগিতা করা তাহেরের বাসার কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীরকে ফাঁসি এবং লাশ গুম করতে সহযোগিতা করা বাকি ২ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় বহাল রাখে।

এরপর আসামি পক্ষ আপিলের রায় রিভিউর আবেদন জানালে উচ্চ আদালত রিভিউ শেষে গত মে মাসে চূড়ান্ত রায়ে একই সাজা বহাল রাখে। রাষ্ট্রপতি প্রানভিক্ষাও নাকচ করে দিয়েছেন। ফলে এখন শুধু রায় কার্যকরের অপেক্ষা। 



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS