ভিডিও

পুতুল খেলার দিনগুলি

সুশান্ত কুমার দে

প্রকাশিত: আগস্ট ০৩, ২০২৪, ০৬:০৫ বিকাল
আপডেট: আগস্ট ০৩, ২০২৪, ০৬:০৫ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

মিলি,টুসি পল্টু ও মণি চারজন মিলে প্রতিদিন বিকেলে ভূতের গল্প,রাজা রানীর গল্প, রাক্ষুস, খোক্ষসের গল্প, বাঘ ভাল্লুকের গল্প আরো কতো রকমের মজার গল্প শুনতো ঠাকুর মার কাছে। গল্প বলার সময় মিলি ও টুসি একটু বেশি বেশি কথা বলতো। ঠাকুর মা এতে রাগ করতেন না। পল্টু ও মণি ভূতের গল্প শুনতে চায়, মিলি ও টুসি রাজা রানীর গল্প শুনতে চায়। কিন্তু ঠাকুর মা ঠিক করেছেন আজ তিনি তার ছোট বেলার গল্প করবেন। ওদের চারজনকে বুঝিয়ে বললেন, আগামীকাল পল্টু ও মণির জন্য ভূতের গল্প বলব। আর পরশুদিন মিলি ও টুসির জন্য রাজা রানীর গল্প বলবো।
সবাই একসাথে বলে উঠলো ঠিক আছে, ঠিক আছে! ঠাকুর মা, বললেন, তা হলে তোমরা সবাই শোন। অনেক দিন আগের কথা আমার বয়স তখন দশ, এগারো বছর হবে। খুব বেশি বুদ্ধি ছিলনা। ঐ সময় পুতুল খেলতে খুব ভালবাসতাম। আমি শিলা, শিউলি এই তিনজন মিলে পুতুল খেলতাম। 
মাটি দিয়ে পুতুল বানিয়ে রোদে শুকাতে দিতাম, তারপর চুলার আগুনে পুড়িয়ে নিতাম। এ ব্যাপারে আমার মা অনেক সাহায্য করতেন।
টুসি বলল, ঠাকুর মা : পুতুলদের কাপড় -চোপড় কোথায় পেতে?
ঠাকু মা বলল, ধীরাজ কাকার দর্জির দোকানে অনেক ছিট কাপড় পড়ে থাকত। সেইসব কুড়িয়ে এনে পুতুলদের সায়া, ব্লাউজ, শাড়ি বানাতাম।  মিলি বললো, পুরুষদের জন্য কি কি পোশাক বানাতে? কেন লুঙ্গি, ধুতি, জামা, প্যান্ট এই সব বানাতাম।
মণি বলল, বাচ্চাদের কি পরাতে? বাচ্চাদেরও পোশাক ছিল হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি।
পল্টু বলল, কি সুন্দর মজাটাই না ছিল তখন। 
টুসি বলে উঠলো, ঠাকু মা, আমরা সবাই পুতুল খেলতে চাই।
শিখিয়ে দেবে? পুতুল খেলা কাউকে শিখিয়ে দিতে হয়নি। ছেলে -মেয়েরা এমনিতেই খেলতে পারতো।
আচ্ছা তোদের  শিখিয়ে দেব।
মিলি বললো, কালকে দুপুরে আমরা এঁটেল মাটি নিয়ে আসব, তুমি কিন্তু আমাদের পুতুল বানিয়ে দেবে? পল্টু বলল, আমি মনিকা পিসির দর্জির দোকান থেকে ঠুকরো কাপড় কুড়িয়ে এনে দেব।
ঠাকুর মা বললেন,আচ্ছা ঠিক আছে!
মিলি বললো , আগেরকার দিনে সব মেয়েরা পুতুল খেলত কেন?
ঠাকুর মা একটু হেসে বললেন, মেয়েদের ভবিষ্যতের বিবাহিত জীবন- যাপনের এটা হয়তো হাতে-খড়ি। মেয়েরা যখন বড় হয়ে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়িতে যায়, তখন তারা একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে গিয়ে পড়ে। জীবনটা ঠিক পুতুল খেলার মতোই- সংসারে সব কিছুই সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে হয়। কোন কিছুতে একটু খানি ভুল হলেই শাশুড়ির কড়া মেজাজটাও শুনতে হতো। ঠিক তেমনি পুতুল খেলা মূলতঃ বাচ্চাদের একটা ক্ষুদ্র মনের ভিন্ন অভিজ্ঞতার ফসল।
তখনকার দিনে ছোট ছেলে-মেয়েদের জন্য কঁড়ি খেলা, লুডু, খুটনী ,বুড়ির ছুট, গোল্লা ছুট, হাঁড়িভাঙ্গা, হা-ডু-ডু, কিতকিত, কানামাছি , ডাংগুলি, কাঁচের গুলি, দড়ি লাফসহ অসংখ্য জনপ্রিয় খেলা ছিল।
আমাদের শৈশবের দিনগুলি কেটেছে ঐ সব খেলাধুলা করেই।
এখন কালের বিবর্তনে সব হারাতে বসেছে।
মিলি ও টুসি হেসে বলল, গ্রামীন সব খেলার অনেকগুলোর নামই শুনিনি আমরা ?
তবে হা-ডু-ডু ও লুডু খেলা দেখেছি !
মিলি বলল, প্রতিবছর ঈদের সময় আমাদের বড় খেলার মাঠটাই  হা-ডু-ডু ও ঢালি খেলা হয়। 
সত্যিই কি অসাধারণ খেলা।
টুসি বলল, আমি লুডু খেলতে পারি।
সেইসাথে পল্টু বলে উঠলো, আমি ডাংগুলি খেলা দেখেছি । স্কুলে যাওয়ার পথে সরদার বাড়ির সামনে অনেকগুলো ছেলে রাস্তার উপর ডাংগুলি খেলে। তবে ভীষণ ভয় করে যদি ঐ গুলি গায়ে এসে লাগে। এসময় মণিও চুপ থাকতে পারলো না।   সে বলল, আমাদের  স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষার পর বিভিন্ন খেলার প্রতিযোগিতা হয়, তারমধ্যে হাই জাম্প, লং জাম্প , বিস্কুট খেলাসহ অনেক খেলা হয়। 
ঠাকুর মা বললেন, ঠিক আছে; তবে তোমরা যে যে খেলার নাম বললে, সেগুলি কি তোমরা নিজেরা খেলেছো, কিংবা কোন প্রতিযোগিতায় নেমেছো?
এ কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেল।
টুসি মাথা চুলকাতে লাগলো, মিলি মুখে আঙুল ঢুকিয়ে নখ ছিঁড়তে লাগল, পল্টু ও মণি কোন উত্তর খুঁজে পেল না, মাথা নীচু করে বসে রইল।
ঠাকুর মা বিষয়টা বুঝতে পেরে বল্লেন, তোমরা কি করে জানবে, বর্তমান ইন্টারনেট, ফিন্টারনেট এসে মানুষ আর খেলা-ধুলা করার সময় পায় না। একদিন হয়তো দেখবে ফুটবল, ক্রিকেট খেলাটিও পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে।আগের দিনে আমরা যেমন খেলাধুলা করেছি, তেমনি পড়াশোনাও করেছি। আজকে সব কিছুই তো হারিয়ে যেতে বসেছে।
আগের দিনে ক্লাসে ওয়ান, টুতে প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ, ধারাপাত,নামতা সব মুখস্থ করতে হতো। না পারলে স্যার খুব মারধর করতেন, সেই ভয়ে অনেকেই স্কুলেই যেত না। আবার দুই তিন দিন স্কুলে না গেলে জরিমানা গুনতে হতো। শিক্ষকদের কড়া শাসন, বাড়ির অভিভাবকরা সহজেই মেনে নিতেন। আর এখনকার দিনে কোন শিক্ষার্থীকে স্যার একটু আধটু চড় মারলে, স্যারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়।
এখনকার দিনে তোমরা কিভাবে -মানুষ হবে -আমি তো তাই ভাবছি। এখন ডিজিটাল যুগ, সবার হাতে  স্মার্ট ফোন। বাচ্চারা গেম খেলে, মোটু -পাতলু কার্টুন দেখে, হাসি মজার জোকস দেখে সময় পার করে। কখন তারা বই পড়বে আর কখন খেলা -ধুলা করবে? ভবিষ্যতে সারাক্ষণ মোবাইল দেখার জন্য চোখ যাচ্ছে, মাথা ঘুরছে, মেজাজ খিটখিটে হচ্ছে।
তোমরা এবার বলো, মোবাইল ফোনটা কে কি ভাবে ব্যবহার করো? পল্টু বলল, আমি অল্প- অল্প ু গেম খেলি। 
মণি বলল, আমি একটু আধটু মোটু পাতলু দেখি।
মিলি বললো, আমি একটু হাসি মজার জোকস্ দেখি।
টুসি বলল, আমি ম্যাসেঞ্জারে একটু বন্ধুদের সাথে মামাদের সাথে কথা বলি, আর ফেসবুক এ কিছু ভিডিও শেয়ার করি।
ঠাকুর মা,বললেন; বাহ্ বাহ্ সবাই তো দেখছি, স্মার্ট ফোন ব্যবহার করছো।
তোমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি খুবই উদ্বিগ্ন।
এভাবে তোমরা কিছু দিনের মধ্যেই আমার গল্পটাও শুনতে আসবে না। খেলা-ধূলা না  করার জন্য মাঠে  গজাবে দুর্বা ঘাস।
এখন তো দেখছি তিন,চার বছরের বাচ্চাদের কান্নাকাটি থামাতে বাবা- মা স্মার্ট ফোন হাতে তুলে দিচ্ছে। বাচ্চাটাও এক মুহূর্তেই কান্না বন্ধ করে  ভিডিও দেখে ও  গান শোনে। শিশুদের এখন আর আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা, চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা- এই সব শ্লোক বলে, ঘুম পাড়াতে হয় না।
আজকে আর তোমাদের সাথে গল্প করবো না। এখন তোমরা সবাই চলে যাও? সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, দ্যাখো বাড়ি ফিরে বই নিয়ে বসতে পারো কিনা? ঠাকুর মার মনটা খারাপ দেখে কেউ আর সাহস করে কোন কথা বলতে পারল না। সবাই মুখটা অন্ধকার করে বাড়ি ফিরে গেল। সেইসাথে ওরা চারজন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো, ঠাকুর মা যে কারণে রাগ করেছে- সেই স্মার্ট ফোনটা, অকারণে ব্যবহার থেকে বিরত থাকব !



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS