সে বছরের ২৬ জুলাই শ্রীনগরের লাল চকে তার ওপর রড ও বন্দুকের বাট নিয়ে হামলা চালায় সেনা সদস্যরা।
আলি মুহাম্মদ ওয়াতালি বলেন, ‘সেনাবাহিনীর একটি গাড়ির সঙ্গে একটি অটোরিকশার সংঘর্ষ হলে সেনাবাহিনীর চালক পালিয়ে যায়। এরপর অটোচালকের মুখ বন্ধ রাখতে হট্টগোল শুরু করে সেনা সদস্যরা। খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। রাস্তার মাঝখানে সেনাবাহিনীর একটি ট্রাক দাঁড়িয়ে ছিল, তাতে কোনো চালক ছিল না। আমি পরিস্থিতি খতিয়ে দেখছিলাম। এরই মধ্যে সাইকেল আরোহী এক শিশুকে নির্দয়ভাবে পেটাতে শুরু করে সেনা সদস্যরা। আমি বাধা দিলে সেনা সদস্যরা রড ও বন্দুক দিয়ে আমার মাথায় ও মুখে আঘাত করে। আমি সেখানে দীর্ঘক্ষণ মৃতপ্রায় অবস্থায় পড়ে ছিলাম।’
তার মুখের হাড় এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে তিনি এখনো চিকিৎসা করাচ্ছেন। তিনি আরো বলেন, শ্রীনগরের বাণিজ্যিক কেন্দ্র লাল চকে সেদিন যত গাড়ি পার্ক করা ছিল, সবগুলোতে সেনা সদস্যরা ভাঙচুর চালায়, নির্বিচারে গুলি চালায়। দুজন মারাও গিয়েছিলেন সেদিন।
ঘটনার তদন্তের ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেখ মুহম্মদ আবদুল্লা। ওই তদন্ত কমিটিতে সেনাবাহিনীর কোর কমান্ডার, হাইকোর্টের বিচারপতি ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন।
আলি মুহাম্মদ ওয়াতালি বলেন, ‘পরে সেনাবাহিনী একটি বিবৃতি দিয়ে বলে, আমি গণপিটুনিতে আহত হয়েছি। বিষয়টি সেখানেই থেমে যায়।’
ভারত শাসিত কাশ্মীরে ১৯৮০ সালে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয় এবং এর পরই সেনাবাহিনী শ্রীনগরের হজরতবাল এলাকায় এক যুবককে মেরে ফেলে দাবি করে, তারা একজন সশস্ত্র চরমপন্থীকে হত্যা করেছে। কিন্তু রিয়াজ রসুল নামের ওই যুবক আসলে জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের কনস্টেবল ছিলেন।
ওই মৃত্যুর ফলে জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশে বিদ্রোহ হয়ে যায়। উর্দিধারী পুলিশ সদস্যরা তাদের অস্ত্র শূন্যে তুলে ধরে শ্রীনগরে একটি মিছিল বের করেছিলেন। পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে ওই মিছিলটির ওপরে নজর রাখা হচ্ছিল। বেশ কয়েকদিন ধরে উত্তেজনা চলতে থাকে এবং অবশেষে সেনাবাহিনী পুলিশ কন্ট্রোল রুমে প্রবেশ করে বিক্ষুব্ধ পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়। পরে বেশ কয়েক ডজন পুলিশ কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। বেশ কয়েক বছর আগে কাশ্মীরের কোলগাম ও গান্দরবাল জেলাতেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
এ ছাড়া অমরনাথ যাত্রা চলাকালীন ২০০২ সালে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা সম্পর্কে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ সদস্য বলেন, ‘সেনাবাহিনীর এক মেজর বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে নিয়ে জোর করে যাত্রীদের শিবিরে অস্ত্র নিয়ে ঢুকতে চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু শিবিরে অস্ত্র নিয়ে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পুলিশ বলেছিল, সেনা সদস্যদের অস্ত্রগুলো বাইরে জমা রাখতে হবে। সে কথা না শুনে সেনা সদস্যরা পুলিশ সদস্যদের মারধর করে। অনেক পুলিশ সদস্য মার খেয়ে বেশ কয়েক সপ্তাহ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
সেনা ও পুলিশের মধ্যে কেন সংঘর্ষ হয়?
সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর বাড়াবাড়ি নিয়ে অনেক বছর ধরে মামলা লড়া একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেছেন, সেনাবাহিনীকে সীমাহীন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যে আইনে, সেখানেই লুকিয়ে আছে পুলিশ আর সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষের মূল কারণ।
তিনি বলেন, ‘কাশ্মীরে আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট (আফস্পা) কার্যকর রয়েছে। সেখানে নিযুক্ত প্রত্যেকটি সেনা জানে যে কেউ তার ক্ষতি করতে পারবে না। এ কারণেই কোনো কোনো সময়ে নিজেদের স্বার্থে তারা সাধারণ মানুষ বা পুলিশকেও টার্গেট করে। কারণ তারা জানে, কোনো আদালত তাদের শাস্তি দিতে পারবে না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা বলছিলেন, ‘এখানকার পুলিশ সদস্যরা এখনো নিজেদের সরকারি কর্মচারী মনে করেন। তারা আইন সম্পর্কে সচেতন। ইউনিফর্ম পরা একজন ব্যক্তির গায়ে হাত তোলার অর্থ কী, সেটাও তারা জানেন। কিন্তু সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রায়ই দেখা গেছে যে তারা আইন সম্পর্কে সচেতন নন। আবার কোনো পরিস্থিতিতে এটাও দেখা যায় যে তাদের মধ্যে নিজেকে সেরা মনে করার একটা মানসিকতা রয়েছে।’
আইনজীবী, পুলিশ কর্মকর্তা ও অন্যান্য বিশ্লেষকরা একমত, কাশ্মীরে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা রক্ষার সমস্যার সমাধান না হলে দেশজুড়ে এর খারাপ প্রভাব পড়বে।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনারা তো দেখতে পাচ্ছেন, ভারতের কোথাও সেনাবাহিনী ট্রেনে ছাত্রদের মারছে, কোথাও বাজারে মারামারি করছে আবার কখনো নিজের বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গেই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। তাই সুষ্ঠু তদন্তের পর দোষীদের শাস্তি দেওয়া আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
‘এসব ঘটনা পুলিশের মনোবল ভেঙে দেয়’
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও বিশ্লেষক আহমেদ আলি ফায়াজের মতে, সেনাবাহিনী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ কাশ্মীরিদের কাছে যত বড় সমস্যা, তার থেকেও অনেক বড় সমস্যা ভারত সরকারের জন্য।
তিনি বলেন, ‘জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশই দেশের একমাত্র বাহিনী, যারা কয়েক দশক ধরে চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে সামনের সারিতে থেকে লড়াই করছে। যদি কোনো জায়গায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয় এবং বিষয়টি প্রমাণিত হয়, তাহলে দোষীদের শাস্তি হওয়াই উচিত। কারণ এই ধরণের ঘটনা জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের মনোবল কমিয়ে দেবে।’
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।