আবদুর রাজ্জাক রাজু
এটা আমাদের দেশে প্রায় স্বাভাবিক তথা গা সওয়া রেওয়াজে বা নিয়মে পরিণত হয়েছে যে, রমজানের আগে থেকেই চলমান মূল্যস্ফীতির বাজারে আরেক দফা নিত্য পণ্যের মূল্য বাড়বে। প্রতি বছরই এই মহিমান্বিত মাসে বাজার অত্যন্ত গরম হয়ে চরমে উঠে অস্থির হয়ে যায়। সারা দেশে পড়ে মহা হৈ-চৈ। গণমাধ্যমেও ঝড় ওঠে। অবশ্য ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের টিকিটাও কেউ ছুঁতে পারে না।
তারা থেকে যায় সর্বদাই অধরা। বিশেষ করে রোজাদাররা এ মাসের চাহিদানুযায়ী যেসব দ্রব্যাদি বেশি ভোগ-উপভোগ করে সেগুলোর দাম লাফিয়ে বেড়ে চলে।
বিশেষ লক্ষ্যণীয় যে, দেশের ৯২ ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী যারা মুসলিম নামে খ্যাত। সারা দেশের সিংহভাগ বা অন্য কথায় প্রায় সব ব্যবসায়ীই বলতে কি মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত। অন্যদের সংখ্যা নগণ্য মাত্র। অপরদিকে খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই বহু মর্যাদার, মাহাত্ম্যের ও তাৎপর্যপূর্ণ সিয়াম সাধনার মাসটিও মুসলিমদের জন্য বিশেষভাবে নির্ধারিত, বিবেচিত এবং সম্মানিত।
অথচ এ মাসে দ্রব্যমূল্য কমিয়ে রোজাদার মানুষকে যথাসাধ্য শান্তি-স্বস্তি দেয়ার পরিবর্তে বরং মুসলিম ব্যবসায়ীরাই তাদের স্বধর্মীয়-স্বগোত্রীয় ভোক্তা ভাইবোনদের সীমাহীন দু:খ কষ্টে ফেলে দিচ্ছেন দৈনন্দিন ব্যবহার্য ভোগ্য পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে। এটা সত্যি বড় অন্যায়, অযৌক্তিক ও অসহনীয়। বলাবাহুল্য এখানে ধর্মীয়, সামাজিক মূল্যবোধ এবং ন্যায় বিচারের দৃষ্টিকোণ কাজ করছে না। আর এ দেশে এই ঘৃণ্য অমানবিক এবং বিবেকবিবর্জিত চর্চাটি নির্বিচারে চলছে বহু বছর যাবত।
এটা যেন দেখেও কেউ দেখে না, প্রতিকার নিয়ে ভাবে না। সরকার বদল হয়, নেতৃত্বের বদল ঘটে। এই দেশে নানা কিছু সংস্কার ও উন্নয়ন সাধিত হয়, কিন্তু রমজানে এই অপকালচার দূর না হয়ে আরো জেঁকে বসে হৃদয়হীন ও গর্হিতভাবে। তাতে কারো বোধ করি বিবেকের রক্তক্ষরণ হয় না, আত্ম জিজ্ঞাসা জাগে না। বড় কথা লজ্জায় কী মাথা নত হয় না? মুসলিম সমাজ ‘তাকওয়ার’ কথা বলে, আল্লাহ ভীতির প্রসঙ্গ বলে। তাহলে এই অপকর্ম-অপকীর্তির প্রতিবাদ কোথায়!
তবে রমজান মাসে ব্যবসায় অতি মুনাফার এই সীমাহীন লোভ-লালসা, লুণ্ঠন এবং অপ্রতিরোধ্য অনৈতিক চর্চা কালে কোথায় থাকে তাদের ইমানী অনুশীলন, জোশ; কোথায় তাদের আল্লাহমুখিতা। কিভাবে বিস্মৃত হয় ইসলামের হেদায়েত ও কল্যাণের বাণী। যারা কোরআন, হাদিস, আল্লাহ ও রাসূল (সা:) এর প্রকৃত খেদমতগার, ভক্ত-অনুরক্ত তারা এ কাজ কিভাবে করে চলে তা কি তারা ভেবে দেখে না? এটা অত্যন্ত জঘন্য অপরাধতুল্য মানবতাবিরোধী ও ইসলামী আমল-আকীদা পরিপন্থী এমনকি সাংঘর্ষিক।
এই হীন মানসিকতা ও গ্লানিকর প্রবণতা পরিহার না করলে ‘মুসলিম’ বলে নিজেদের দাবি করা ন্যায্য হবে না। যার দ্বারা মানুষের কষ্ট হয়, বিড়ম্বনা বাড়ে সে উত্তম মানুষ হতে পারে না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র সরকার, প্রশাসন ও সমাজ সবাই যেন ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। কারো হুংকার ও হেদায়েতই কেউ শুনছে না।
বিশেষ করে সর্ব শ্রেণীর ও স্তরের ব্যবসায়ী মহল কঠিন ও পাষাণ হৃদয়ে রোজাদার মুসলিমদের অপরিসীম যন্ত্রণা-বেদনার সৃষ্টি করছে পবিত্র রমজান মাসে প্রতিটি জিনিসপত্রের মূল্য দফায় দফায় বৃদ্ধি করে। এখানে জবাবদিহির বিশাল ঘাটতি রয়েছে।
এ যেন রমজানের সাথে বাজার মূল্য বৃদ্ধির জঘন্য প্রতিযোগিতা। অবৈধ কামাই-রোজগারের এটাই যেন বড় সুযোগ। বর্তমান মূল্যস্ফীতির সময়ে এটা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা বটে। এখানে ধর্মনীতির আদর্শ সব জলাঞ্জলি। ন্যূনতম মানবিক ও বিবেকবোধ বিবর্জিত। এটা শুধু দুষ্কৃতি-দুর্নীতি নয়, এটা ইসলামবিরোধী ও আল্লাহর নির্দেশিত মত, পথ, বিশ্বাস ও তরিকার বিপরীতমুখীতা, এক ধরনের বর্বরতা, অসভ্যতা। তাই রাষ্ট্র, সরকার নির্বিশেষে সবার প্রতি বিনীত আহ্বান-এই অগ্রহণযোগ্য শয়তানি মন-মানসিকতা থেকে তথা অর্থ-স্বার্থের লোভ-মোহ পরিত্যাগ করে বিশেষত রমজানে দেশের বিদ্যমান আইন কানুনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সম্পূর্ণ হালাল ও ন্যায্যতার দৃষ্টিকোণে ব্যবসা-বাণিজ্য আর বেচাকেনা করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
চেয়ে দেখুন, কাতার ও আরব আমিরাতের মতো মুসলিম দেশগুলোতে শত শত নিত্য পণ্যের মূল্য রমজান মাসে হ্রাস করেছে মানুষকে একটু সহমর্মিতা ও স্বস্তি দেয়ার জন্য। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে অত্যন্ত আপত্তিকর এই হীন, নিম্ন, ইতরোচিত চিন্তা চর্চা ও ভোগ উপভোগের লালসা শুধু দেশেই নয় বহির্বিশ্বেও চাউর এবং নিন্দিত হয়। কেননা প্রযুক্তির সুবাদে বিশ্বের সবাই প্রতিনিয়ত জেনে যাচ্ছে আমরা এই রমজানে ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষেত্রে কী কান্ডটা করে চলেছি।
কোন বিধর্মীরাও এই নির্মম বৈশিষ্ট্য বহন করে না। এটা যত দ্রুত সম্ভব অবশ্যই পরিত্যাজ্য এবং এই দুষ্ট চক্র হতে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। এজন্য সরকার ও রাষ্ট্রকে সর্বাত্মক ও সর্বপ্রকার আইনী নীতিগত প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। এ সমাজরীতি ইসলামের সাথে আদৌ মানায় না, খাপ খায় না। সরকারের অবশ্যই দায়বদ্ধতা রয়েছে। এই নীতি বিরুদ্ধ আর্থ-সামাজিক প্রথা রুখে দিতে যা কিছু করণীয় তা করতে। সে জন্য কোনো দেরি নয়। কারণ রমজান তো এসে পড়েছে, শুরু হয়ে গেছে।
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক চলনবিল বার্তা, তাড়াশ, সিরাজগঞ্জ।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।