খাদ্য পণ্যে ভয়াবহ ভেজালের দৌরাত্ম্য কিছুতেই কমছে না। মুনাফার লোভে মানবিক মূল্যবোধকে জিম্মি করে ফেলছে। বাংলাদেশের হাজারও সমস্যার মধ্যে অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো খাদ্যে ভেজাল। খাদ্যে ভেজাল আজ আমাদের জাতীয় জীবনে এক মহাদুর্ভোগের নাম। অথচ মানুষের সুস্বাস্থ্য ও বেঁচে থাকার জন্য পুষ্টিকর খাবার অতি জরুরি। ফলে বাংলার মাটি থেকে খাদ্যে জীবনসংহারী ভেজাল মেশায় যারা, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ।
বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে খাদ্যে ভেজালের সংবেদনশীল খবরগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পাঠকদের উদ্বেগ বাড়িয়ে চলেছে। বড় বড় শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এসব ভেজাল খাদ্য পণ্য। কেবল মুনাফার লোভে কিছু অসৎ ব্যবসায়ী খাদ্য পণ্যে ভেজাল মেশাবে। শত শত মানুষের স্বাস্থ্য হানি, এমনকি মৃত্যুরও কারণ হবে। বড় বড় প্রতিষ্ঠানের জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের নাম ব্যবহার করে এসব ভেজাল খাবার বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসটিআইয়ের নকল সিলও ব্যবহার হচ্ছে অনেক খাদ্য পণ্যের প্যাকেটের গায়ে। এসব দেখারও যেন কেউ নেই। বাজার থেকে ভেজাল খাদ্য কিনে অসুস্থ হচ্ছে অনেকেই। কয়েক বছর আগে ভেজাল নিয়ে একটি গবেষণার ফল গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের দেড় যুগের অব্যাহত সেই গবেষণা থেকে জানা যায়, দেশের ৫৪ শতাংশ খাদ্য পণ্যে ভেজাল রয়েছে। তথ্যটি উদ্বেগজনক হলেও সত্য যে, গত কয়েক বছরে দেশে খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার প্রবণতা একটুও কমেনি, বরং বেড়েছে। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সব পর্যায়ে পৌছে যাচ্ছে ভেজাল খাদ্য পণ্য। ফলমূল, শাক সবজি, মাছ-মাংসে ব্যবহার করা হচ্ছে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথোফেন ও ফরমালিন।
ফরমালিনযুক্ত গুঁড়া দুধ দিয়ে তৈরি হচ্ছে মিষ্টি। বিক্রি হচ্ছে শহর ও গ্রামাঞ্চলে। কৃত্রিম উপায়ে পাকানো হচ্ছে মৌসুমি ফল। তেল, ঘি, ফলের জুস ইত্যাদিতেও মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকর রাসায়নিক ও রং। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব খাদ্য ও ফলমূল থেকে কিডনি, পাকস্থলী ও মস্তিস্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকিও রয়েছে। দেশের পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা খাবারে ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, সিসা, ফরমালিন, অ্যালড্রিন, বেনজয়িক এসিড ইত্যাদি পাওয়া গেলেও ভেজাল নিরোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই।
এটা সত্য, বর্তমানে খাদ্যে ভেজাল অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। বিশেষ করে ভেজাল শিশু খাদ্য বিক্রি করা অমার্জনীয় অপরাধ। দেশে খাদ্য নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উৎপাদন করেই হোক কিংবা আমদানি করেই হোক, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মনে রাখতে হবে, খাদ্য নিরাপত্তা এ দেশের জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। সেই সাংবিধানিক অধিকার সামনে রেখেই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
বিএসটিআইর মান উত্তীর্ণ পরীক্ষায় নামিদামি ৫২টি কোম্পানির পণ্যের মান অনুত্তীর্ণ হওয়া তারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ২০১৯ সালে হাইকোর্ট এসব খাদ্য পণ্য বাজার থেকে অপসারণ করে ধ্বংসের নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। মানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত ওই সব পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ করতেও নির্দেশ দেন।
বাংলাদেশে ভেজালযুক্ত খাদ্য পণ্য নেই যেখানে ভেজাল নেই। পাঁচ দশকের আগের চেয়ে মানুষ প্রায় দ্বিগুণ খাদ্য গ্রহণের সুযোগ পেয়েছে। এ সাফল্য সত্ত্বেও বাংলাদেশের খাদ্যের মান নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। খাদ্য নিরাপত্তা পাশ কাটিয়ে এখন আলোচনার মূখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে নিরাপদ খাদ্য। খাবারে ভেজালের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায়ই খাদ্য চালান ফেরত আসে নিরাপত্তার অজুহাতে। খাবারে ফরমালিন মেশানো হচ্ছে।
ফল দ্রুত পাকাতে দেওয়া হচ্ছে কারবাইড। সবজিতেও ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানো হচ্ছে। মানুষ খাদ্য গ্রহণ করে জীবনীশক্তি অর্জন ও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু ভেজাল ও ক্ষতিকর খাদ্য মানুষের জীবনীশক্তি কেড়ে নেয়। সুস্থতার বদলে অসুস্থতা নিয়তির লিখন হয়ে দাঁড়ায়। এ বিপদ কাটাতে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করণেও উদ্যোগী হতে হবে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।