ভিডিও

সড়ক দুর্ঘটনা কি অপ্রতিরোধ্য

ওসমান গণি

প্রকাশিত: মে ১৩, ২০২৪, ০৭:০৭ বিকাল
আপডেট: মে ১৩, ২০২৪, ০৭:১০ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশে মহামারি আকার ধারণ করছে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়। প্রতিদিনই বাংলাদেশের কোন না কোন অঞ্চলে নিয়মিতই মহাসড়কে  ও সড়কের দুর্ঘটনা ঘটেই চলছে। এতে করে অনেক মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে অনেক মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করছে। কান-পাতলে শোনা যায় নিহত বা আহতদের পরিবারের কান্নার শব্দ। এ সমস্ত পরিবারে উপার্জনক্ষম কোন লোক না থাকার কারণে অনাহারে দিন কাটছ এসব পরিবারের।

সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশের জন্য একটি সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে, অনেক পূর্ব থেকেই দুর্ঘটনা অহরহ ঘটে আসছে। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। সরকারি সংস্থা বিআরটিএর হিসাবেই এবারের ঈদযাত্রায় মৃত্যু হয়েছে ৩২০ জনের, যা গত বছরের ঈদযাত্রার চেয়ে ১৯ শতাংশ বেশি। একেকটি মৃত্যু শোকগ্রস্ত করেছে স্বজনদের, অসহায় করেছে পরিবারগুলোকে।

ফরিদপুরে গত ১৬ এপ্রিল বাস ও ছোট ট্রাকের সংঘর্ষে ১৫ জনের মৃত্যুর পর জানা গিয়েছিল, বাসটির ফিটনেস সনদ নেই। অবৈধভাবে ট্রাকে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছিল। সড়কেও ছিল কিছু খানাখন্দ। পরে জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি জানায়, অতিরিক্ত গতি, বাসচালকের ঘুম ঘুম ভাব এবং বাসের সামনে ইজিবাইক এই দুর্ঘটনার কারণ।

বাসের ফিটনেস আছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)। ট্রাকে যাত্রী তোলা ও অতিরিক্ত গতি ঠেকানো এবং তিন চাকার যান মহাসড়কে চলাচল বন্ধ রাখার দায়িত্ব হাইওয়ে পুলিশের। সড়ক খানাখন্দমুক্ত রাখার কাজটি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ)। আর চালকের বিশ্রাম নিশ্চিত করার দায়িত্ব মালিকপক্ষের।

শুধু ফরিদপুর নয়, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় ২২ এপ্রিল বাসের ধাক্কায় চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর জানা যায়, বাসটি ফিটনেসহীন, ৪৩ বছরের পুরোনো। এর পাঁচ দিন আগে (১৭ এপ্রিল) ঝালকাঠিতে সিমেন্টবাহী ট্রাকের চাপায় ১৪ জনের মৃত্যুর পর বেরিয়ে আসে, চালকের ভারী যান চালানোর লাইসেন্স ছিল না। দুর্ঘটনা বললে দৈব বা প্রকৃতির ওপর দায় চাপানো হয়ে যায়। আসলে দুর্ঘটনা ঘটার সব উপকরণই এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান ছিল।

তাই এটাকে অবহেলাজনিত হত্যাকান্ড বলা হবে কি না, তা ভাবার বিষয়, অবহেলায় যাঁরা যাঁরা জড়িত, তাঁদের প্রত্যেকের বিচার হওয়া দরকার। নইলে অনিয়ম ও অবহেলা চলতেই থাকবে।দেশের সড়কে প্রতিবছর পাঁচ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। আহত হচ্ছেন এর চেয়ে বেশি। কিন্তু সড়কগুলোতে শৃঙ্খলা ফেরাতে জোরালো উদ্যোগ নেই। মাঝে মধ্যে কিছু ভ্রাম্যমাণ আদালত চালানো হয়, কিছু জরিমানা হয়; কিন্তু পরিকল্পিত, সমন্বিত কোনো কার্যক্রম চালানো হয় না।

এবারের পবিত্র ঈদুল ফিতরকেন্দ্রিক ঈদযাত্রায় বহু মানুষের মৃত্যু ও তিনটি বড় দুর্ঘটনার পর বিআরটিএ আবার সেই ‘নামকাওয়াস্তে’ অভিযান শুরু করেছে। তবে সেটা কতটুক সফল হবে বা কতদিন চলবে তা বলা যাচ্ছে না। এভাবে কোন মতেই সড়ক দুর্ঘটনা রোধ সম্ভব হবে না বলে মনে হয়। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকারের কার্যক্রমকে চলমান রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন দেশের বিজ্ঞ মহল।

দুর্ঘটনায় পরিবারের একজন মানুষ নিহত কিংবা পঙ্গু হয়ে গেলে ভুক্তভোগী পরিবারের সারাজীবনের কান্না। সেখানে একেকটি অস্বাভাবিক দুর্ঘটনায় পুরো পরিবারের প্রায় সব সদস্য একই সঙ্গে নিহত হওয়ার ঘটনাগুলো জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। বছরের পর বছর ধরে এমন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে মানুষ। দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকারের বিষয়বস্তু সব সময়ই এক ও অভিন্ন। কেন,কি কারণে এমন সব ট্রাজিক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণ দিচ্ছে মানুষ, তা কারো অজানা নয়।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদফতর ও গণপরিবহনের মালিক-চালক-হেল্পারদের গতানুগতিক দায়িত্বহীনতা এবং প্রয়োজনীয় বিধি-ব্যবস্থার গ্রহণ করতে না পারার ব্যর্থতা কখনোই আড়াল করা যায়নি। অথচ কেউই এসব দুর্ঘটনার দায় নিচ্ছে না। কাউকেই জবাবদিহিতা করতে হচ্ছে না। কোনো সভ্য সমাজে এমনটা আশা করা যায় না। পশ্চিমা কোনো দেশে এমন ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে দেখা যায়।

প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিরা বিচার ও আইনগত জবাবদিহিতার বাইরে থাকায় সড়ক-মহাসড়ক, রেলপথ ও নৌপথে মৃত্যুর মিছিল থামানো কিংবা কমিয়ে আনা যাচ্ছে না। সরকার ও মন্ত্রণালয় সড়কের উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলেও মানুষের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিতে কোনো উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।

সড়কের অপরিকল্পিত উন্নয়ন, লেন বৃদ্ধি ও উচ্চ ব্যয়ে নির্মিত উন্নত যোগাযোগ অবকাঠামো মানুষের যাতায়াতে নিরাপত্তা দিতে পারছে না। একেকটি অগ্নিকান্ড কিংবা পরিবহন দুর্ঘটনায় বহুল ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির পর জানা যায়, ভবনটি সঠিক নকশায় তৈরী হয়নি। পরিবহনটির কোনো লাইসেন্স কিংবা ফিটনেস ছিলনা। ঝালকাঠিতে প্রাইভেটকার চাপা দিয়ে একই পরিবারের ৬জনসহ মোট ১৫জনকে হত্যাকারী ট্রাকটির নাকি কোনো বৈধ কাগজপত্র ছিল না!

সংবাদ মাধ্যমে  প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদনে জানা যায়, সড়কে ৬ লাখ অবৈধ যান চলাচল করছে। অধিকাংশ অবৈধ ও ফিটনেস বিহিন যানবাহনের কারণে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির হার বেড়ে চলেছে। গত ১১ বছরে সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার ১ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলেও সড়কপথকে নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল করা যায়নি।

এ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতা ও উদাসীনতা সীমাহীন। যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে জনগণের লক্ষকোটি টাকা খরচ করার পেছনে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির যোগসাজসের অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

লাখ লাখ অবৈধ, ফিটনেসহীন যানবাহন, লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ গাড়ী চালক বছরের পর বছর ধরে সড়ক-মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়ানোর পেছনেও রয়েছে বছরে শত শত কোটি টাকার ঘুষ-দুর্নীতি-চাঁদাবাজির যোগসূত্র। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, বিআরটিএ, ট্রাফিক বিভাগ এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী মালিক-শ্রমিক সমিতি এসব দুর্ঘটনা, দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতার দায় এড়াতে পারে না।

প্রতিটি দুর্ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত, বিচার এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ক্ষতিপুরণ নিশ্চিত করা গেলে দুর্ঘটনা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। সড়কে দুর্ঘটনার পাশাপাশি পথে ও গণপরিবহনে ছিনতাই, রাহাজানি, প্রতারণা, অজ্ঞানপার্টি, মলম পার্টির খপ্পরে পড়ে প্রতিদিন অনেক মানুষ সর্বস্ব হারাচ্ছে।

অন্যদিকে পুলিশ ও ট্রাফিক বিভাগের একশ্রেণীর ব্যক্তি চাঁদাবাজিতেই বেশি ব্যস্ত। জননিরাপত্তা নিয়ে তাদের যেন কোনো দায়িত্ব, মাথাব্যথা ও জবাবদিহি নেই। পথের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিষয়ে গণপরিবহন যাত্রী, সব ধরনের গাড়ী চালক-হেল্পার ও পথচারীদের সচেতন থাকা জরুরি। এসব মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন করতে হবে।


লেখক : সাংবাদিক-কলাম লেখক

ganipress@yahoo

01818-936909



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS