সরোয়ার রানা
মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে, মনটা খুব খারাপ। প্রতি শুক্রবারে দলবেঁধে মাঠে খেলতে গেলেও আজ কাউকে পাচ্ছি না। ঘর থেকে একটু দূরেই স্কুল। বর্ষাকালে সমস্ত মাঠ ঘাট যখন ডুবে থাকে তখনও স্কুলের মাঠ ফুটবল খেলার উপযোগী থাকে। তাই কয়েক গ্রামের ছেলে-মেয়ে এখানে খেলাধুলা করতে আসে। আজ বৃষ্টির জন্য কেউ আমার সাথে গেল না। বাড়ির কেউ না থাকায় আমি মন খুলে ফুটবল খেলতে পারলাম না। কিছুক্ষণ ফুটবল খেলে বাড়ি ফিরতে পথ ধরলাম। ফেরার পথেই বিশাল বড় পদ্ম দীঘি। আমাদের গ্রাম বড় বড় দিঘি আর গাছপালা দিয়ে ঢাকা। এই পদ্ম দিঘি এমন একটি জায়গা, লোকজন এই রাস্তা পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে। আমি সহজে বাড়ি পৌঁছানোর জন্য এ রাস্তা দিয়ে চলাচল করি। সচরাচর আমি একা চলাচল করি না কিন্তু আজকের ঘটনা ভিন্ন তাই একা আসতে হলো।
লোকে এটাকে কেন পদ্মদিঘী বলে আমি ঠিক জানিনা। হয়তো কোন এক কালে এখানে পদ্ম ফুল ফুটে থাকত। দিঘির একপাশে জরাজীর্ণ অবস্থায় জমিদার বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এই জমিদার নাকি প্রজাদের উপর অনেক অত্যাচার করত। লোকে বলে পাপের জন্য এই জমিদারের বংশ নির্বংশ হয়ে বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে অনেক বছর ধরে। জমিদার বাড়ির আশেপাশে অনেকগুলো দেশি ফলের গাছ আছে। আমরা প্রায় সময় দল বেঁধে ফল পেড়ে খায়।
পদ্ম পুকুরের জাম গাছতলায় একবার জাম কুড়াচ্ছিলাম। জাম কুড়িয়ে দিঘীর এক কোণায় নেমে হাত মুখ ধুয়ে যখন পাড়ে উঠলাম তখন ভয় পেলাম। এইমাত্র যেখানে মুখ ধুয়ে উঠেছি সেই জায়গা থেকে ইয়া বড় এক গোখরা সাপ বের হলো। একটুর জন্য সেদিন বেঁচে গেলাম। পদ্ম দীঘিকে নিয়ে নানারকম মুখরোচক গল্প আছে। শোনা যায় এই দীঘিতে নাকি ভূত থাকে। অনেকেই পুকুর নেমে আর উঠে আসতে পারেনি ।
পদ্ম পুকুরে পদ্ম ফুল না থাকলেও দিঘী জুড়ে শাপলা রাজত্ব করছে। আমরা যখন দলবেঁধে আসি তখন এই পুকুরে নেমে শাপলা ফুল তুলি। শাপলা ফুলের ডাটা খেতে অনেক মজা। তার সাথে শাপলার ঢ্যাপা ফল আমার খেতে ভালো লাগে। যেহেতু আজকে সাথে কেউ নেই তাই মনে মনে চিন্তা করলাম একা একা দিঘীতে নামা ঠিক হবে না । কিছুদিন আগে আমি এই দিঘী থেকে শাপলা ফুল ছিঁড়ে ডাটার উপরে আঁশ দিয়ে একটা সুন্দর খেলনা বানিয়ে খেলছিলাম। এটা দেখে আমার ছোট বোন শানু আবদার করে বলল, আমার জন্য আগামীকাল শাপলা ফুল নিয়ে আসবি। বোনের কথা মনে করে মনস্থির করলাম আমি পদ্মদিঘীতে নামব। আরেকবার আশেপাশে তাকিয়ে হতাশ হলাম। দুপুরের ঝিমঝিম রোদ আমাকে চোখ রাঙিয়ে যেন বলছে, শান্ত ছেলের মত ঘরে ফিরে যাও, আর ঘুমিয়ে পড়ো। দুপুরে ঘর বের হওয়া ভালো না, দুপুরে বের হলে বিপদ হতে পারে!
আমি অবচেতন মনের নিষেধকে তোয়াক্কা না করে পানিতে নেমে পড়লাম। পানিতে নামা মাত্রই আমার খুবই আরাম বোধ হলো। স্বচ্ছ পানিতে সাঁতার কাটার লোভ সামলাতে পারলাম না।আমি শাপলার বন দুহাতে সরিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে বেশ কিছু চলে এলাম। আরও একটু দূরে কয়েকটা ঢ্যাপা ফল দেখতে পেলাম। সেগুলো আনতে আমি অনেকটা দূর চলে এলাম। হাতে কয়েকটা শাপলার ডাটা আর ঢ্যাপা ফল নিয়ে কিনারার পৌঁছনোর জন্য সাঁতার কাটতে লাগলাম। হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে কে যেন আমার পা ধরে টান মারল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিছুক্ষন জ্ঞানশূন্য হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। স্বাভাবিক হতেই আমি ভয় পেয়ে গেলাম । এটা কি হতে পারে, এটা কি পদ্ম দীঘির সেই ভয়ানক ভূত! ওরে বাবারে, আমি আজ কার খপ্পরে পড়লাম ? আমার সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল। আমার হাত আর চলছে না। আমি ঢ্যাপা ফল আর শাপলার ডাটা হাত থেকে ফেলিনাই। আমি আবার সাঁতার কাটা আরম্ভ করলাম কিন্তু যতই সামনে যেতে চাইলাম মনে হচ্ছে আমি আরো পিছনে ফিরে যাচ্ছি। কিছুদূর যাওয়ার পর আবারও পা ধরে হেঁচকা টান টান মারল। এবার অনুভব করলাম আশেপাশে কিছু একটা ঘোরাঘুরি করছে। এবার আমার পায়ে কামড় বসিয়ে দিল। আমি ব্যাথায় কাতর হয়ে জোরে চিৎকার করলাম। এবার হাতে থাকা সবকিছু ফেলে জোর হাতে সাঁতার কাটতে লাগলাম। আমি যতই জোরে পা চালাতে লাগলাম ততই যেন আমি আটকা পড়ছি। হায় হায় কিছু একটা আমাকে ভিতরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আবারও আমার পায়ের পাশে কারো অস্তিত্ব অনুভব করলাম। যখন আমার পায়ের কাছে এল আমি সাহস করে জোরে লাথি মারলাম। লাথিটা তার গায়ে পড়ার সাথে সাথে আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেল। আমি এবার প্রাণপণে হাত পা ছুড়ছি। এবার নিজেকে আবিষ্কার করলাম আমার পা দুটি শাপলা লতার সাথে পেঁচিয়ে গেছে।
শান্ত মাথায় ঘটনাটা বোঝার চেষ্টা করলাম আমার সাথে কি ঘটছে। একটু দূরে খেয়াল করে দেখলাম শাপলা পাতার উপর একটা ব্যাঙ বসে আছে। চোখের পলকে একটা বড় বোয়াল মাছ সেই ব্যাঙের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পানিতে তলিয়ে গেল।
আমি বুঝতে পারলাম বোয়াল জাতীয় কোন মাছ আমাকে আক্রমণ করেছে। এবার ঘটনাটা পরিষ্কার হলো।
আর এদিকে আমি যত জোরে সাঁতার কাটতে চেষ্টা করছি ততই আমি শাপলার লতায় আটকে যাচ্ছি। খুব সাবধানে শাপলার লতা থেকে বের হয়ে এলাম। এবার খুব ধীরে ধীরে সাঁতার কাটছি। আমার সাঁতার কাটতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এসবের মধ্যেও আমার বোনের আবদারের কথা মনে পড়ে গেল। তাই সাঁতার কাটতে কাটতে দুইটা শাপলা ফুল আর একটা ঢ্যাপাফল তুলে নিলাম। অবশেষে আমি কিনারায় চলে এলাম। সবুজ ঘাসে শুয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলাম। একটু বিশ্রাম নিতে আমার পূর্ণ শরীরে শক্তি ফিরে এলো। এবার চারদিকে চোখ বুলাতে লাগলাম। একটু দূরেই বোয়াল মাছ লাফিয়ে উঠল। হয়তো ব্যাঙ না হয় ঘাস ফড়িং শিকার করছে।
আমি নিজে নিজে কিছুক্ষণ হাসলাম মনে মনে বললাম বোয়াল মাছের দোষ গিয়ে পড়ল ভূতের উপর। এই অপবাদ নিয়ে যদি ভূত রাগ করে তাহলে জনগণের কি হবে!
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।