অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে দেশের বিভিন্ন খাতে সংস্কার চলছে। সেই বাতাস লেগেছে চলচ্চিত্রাঙ্গনেও। ইতোমধ্যেই সেন্সর বোর্ড বাতিল করে সার্টিফিকেশন বোর্ড তৈরি হয়েছে। এছাড়াও চলচ্চিত্র অনুদান কমিটি, আমদানি-রপ্তানি কমিটি, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-২০২৩’র জুরি বোর্ড ও চলচ্চিত্রবিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি পুনর্গঠিত হয়েছে।
নতুন এই কমিটিগুলো নিয়েই সম্প্রতি ফেসবুকে একটি দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়েছেন নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। যেখানে তার নিজস্ব মত তুলে ধরেছেন তিনি। এই নির্মাতা বলেন, ‘‘চলচ্চিত্র বিষয়ক যতগুলো কমিটি হয়েছে তার মধ্যে পরামর্শক কমিটিই আমার বিবেচনায় সবচেয়ে ভালো হয়েছে। বাকি কমিটিগুলোতে যোগ্য লোক যেমন আছে, কিছু বিস্ময়কর নামও আছে। এই সমালোচনাটা করে রাখা দরকার যাতে সরকার বুঝতে পারে। নাহলে আগের আমলের মতো ‘কর্তা যা করেছেন মাইরি’ সিচুয়েশন বানিয়ে ফেলব আমরা।’’
ফারুকীর কথায়, ‘আমার বিবেচনায় এখানে আরও কিছু অংশীজন থাকা উচিত ছিল। যেমন ফাহমিদুল হক, বিধান রিবেরু, অমিতাভ রেজা চৌধুরী, মেজবাউর রহমান সুমন, নুহাশ হুমায়ুন। স্বচ্ছতার জন্য বলে নেয়া ভালো আমাকে অনুরোধ করা হয়েছিল পরামর্শক এবং আরেকটা কমিটিতে থাকার জন্য। আমি ব্যক্তিগত কারণে থাকতে চাইনি। এখন যাদের নাম উল্লেখ করলাম তারা থাকতে অপারগতা জানিয়েছে কিনা আমি জানি না।’
কিছু পরামর্শও তুলে ধরে নির্মাতা বললেন, ‘আমার বক্তব্য থাকবে—এই পরামর্শক কমিটি থেকে পরামর্শ যা যাবে তা যেন অংশীজনরাই তৈরি করে দেন। সরকারি কর্মকর্তারা কেবল এক্সিকিউশনের দিকটা দেখা উচিত। নীতি প্রণয়নে তারা হাত না দেয়াই ভালো হবে, কারণ তারাতো আমাদের সমস্যা এবং প্রয়োজনটা জানেন না।’
এছাড়া চলচ্চিত্র শিল্পে কার্যকর পরিবর্তন আনতে সিনেমা হলে ই-টিকিটিং ও রেভিনিউ শেয়ার ব্যবস্থার ওপর গুরুত্বারোপ ফারুকী। তিনি বলেন, ‘‘শিল্পকলা একাডেমির জমি আছে মোটামুটি দেশজুড়েই। কমপক্ষে ৩০ জেলায় শিল্পকলার জায়গায় মাল্টিপ্লেক্স করে সেটা দরপত্রের ভিত্তিতে প্রাইভেট ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। যেহেতু আমাদের জাতিগত দুর্নাম ‘আমরা শুরু করি, অব্যাহত রাখি না’, সেহেতু এইসব মাল্টিপ্লেক্সকে মনিটরিংয়ে রাখতে হবে এর মেইনটেনেন্স ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা। নাহলে লিজ বাতিলের শর্ত থাকতে হবে। এখন ঝামেলা হলো শিল্পকলা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন। আর সিনেমা-টিভি-ওটিটি তথ্য ও সম্প্রচারে। এই দুই মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় করে হলেও এটা করা দরকার।’’
চলচ্চিত্র তহবিল ও অনুদানের বিষয়ে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটা হচ্ছে ফিল্ম ফান্ড এবং সাপোর্ট সিস্টেম। আমাদের সামনে বুসান, সানড্যান্স, বার্লিন, রটারডাম, ফিল্মবাজার স্ক্রিন রাইটার্স ল্যাবের উদাহরণ আছে। আমি মনে করি, পরামর্শক কমিটির উচিত অনুদান প্রথাতে আমূল পরিবর্তন আনা। ৫০ ভাগ ছবি ফার্স্ট এন্ড সেকেন্ড টাইম ফিল্মমেকারদের জন্য বরাদ্দ থাকা উচিত। এই ৫০ ভাগের মাঝে কমপক্ষে অর্ধেক নারী ফিল্মমেকারদের জন্য থাকা উচিত। তো এই নতুন পরিচালকদের স্রেফ ফান্ড দিয়েই হাত গুটিয়ে ফেলা যাবে না। স্ক্রিন ল্যাবের মতো ইনকিউবিটরে লোকাল এবং ইন্টারন্যাশনাল মেন্টর দিয়ে এদের সহায়তা করতে হবে। পাশাপাশি আমাদের অনুদান পলিসি নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবা উচিত। আমরা কোন ধরনের ছবিকে অনুদান দিব? ইরানের মতো সোশ্যালি রিলেভ্যান্ট এবং ইমপ্যাক্টফুল স্টোরিটোলিং? নাকি কলকাতা আর্টহাউজের দুর্বল ফটোকপি? নাকি বেলা তারের মতো ছবি? আমার বিবেচনা হচ্ছে আমাদের এখানকার মানুষ, তাদের সম্পর্ক, আবেগ, পাগলামো এসব মিলিয়ে আমাদের আশেপাশে নিজস্ব গল্প এবং চরিত্রেরা হেঁটে বেড়াচ্ছে। এইসব নিয়ে সোশ্যালি রিলেভ্যান্ট ছবির সংখ্যা বাড়লেই আমরা সত্যিকারের বাংলাদেশী নিউ ওয়েভ হতে পারব।’
ইতিহাসনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণের বিষয়েও বলেছেন ‘টেলিভিশন’খ্যাত এই নির্মাতা। তার ভাষায়, ‘লাতিন আমেরিকার স্বৈরশাসন এবং দুঃশাসন আপনি খুঁজে পাবেন তাদের সাহিত্যে-সিনেমায়। আমাদের গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদের কাল তুলে ধরার কাজে এই অনুদান কাজে লাগানো যায় কিনা দেখতে হবে। তবে আওয়ামী যুগের মতো শ্লোগান সর্বস্ব যেন না হয় খেয়াল রাখতে হবে। একই সাথে পরামর্শক কমিটির উচিত অনুদান কমিটি পুনর্গঠন করা। নতুন পলিসির আলোকে যারা এটা এক্সিকিউট করতে পারবে তাদের রাখা উচিত। দেখেন ব্যক্তি খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
ফারুকী আরও বলেন, ‘এখন যে অনুদান কমিটি করা হয়েছে সেখানে এক-দুই জন যোগ্য লোক থাকলেও এটা অনেকটাই আওয়ামী লীগ আমলের মতোই ব্যাকডেটেড কমিটি। আর এই কমিটির কে কীভাবে ফ্যাসিবাদের কালচারাল উইংয়ের ফুটসোলজার ছিল সেই আলাপে গেলাম না। আমি মনে করি এই কমিটিতে থাকা উচিত ছিল তাদের যাদের সারা দুনিয়ায় এই কাজগুলো কীভাবে হচ্ছে সেটার ফার্স্ট হ্যান্ড অভিজ্ঞতা আছে। বিদ্যমান কমিটির যোগ্য দুয়েকজনের পাশাপাশি আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ, নুহাশ হুমায়ুন, আরিফুর রহমান, তানভীর হোসেন, সালেহ সোবহান অনীম, আদনান আল রাজীব, কামার আহমেদ সায়মন, হোমায়রা বিলকিস এদের মধ্য থেকে কেউ কেউ থাকলে আমরা একটা ফরওয়ার্ড লুকিং ভিশন পেতাম।’
ব্যক্তির ওপর অনেক কিছু নির্ভর—এমন ভাবনা প্রকাশ করে ফারুকী বলেন, ‘অনেকে ভাবতে পারেন আমি ব্যক্তির ওপর কেন গুরুত্ব দিচ্ছি। দিচ্ছি, কারণ ব্যক্তির কারণেই আকাশ-পাতাল পার্থক্য রচিত হয়। মোহাম্মদ আযম আর মিডিওকার কোনো রাম-শ্যাম এক জিনিস না। সৈয়দ জামিল আহমেদ আর লাকী এক জিনিস না।’
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।