সংসদ রিপোর্টার : জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীনদের টানা ১৬তম এবং দেশের ৫৩তম বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। আজ বৃহস্পতিবার সংসদে ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করবেন তিনি। এবার তার বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার’। এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতি বজায় রাখার লক্ষ্যে বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ অঙ্কের বাজেট। মূলত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দিকে নজর দিতে গিয়ে বাজেটের আকার বাড়াতে পারেনি সরকার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৮ লাখ কোটি টাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখছেন দেশের ১৮তম অর্থমন্ত্রী। যেখানে আড়াই লাখ কোটি টাকারও বেশি বাজেট ঘাটতি পূরণে দেশি-বিদেশি ঋণ নিতে হবে। অতীতের রেকর্ড ভেঙে বাজেটের প্রায় ৬৪ শতাংশ অর্থ পরিচালন ব্যয়ে বরাদ্দ রাখা হয়েছে এবার। এক রকম বাধ্য হয়েই আরও ১৪ শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে হবে ঋণের সুদ পরিশোধে।
নাগালের বাইরে মূল্যস্ফীতি : হিসেব মতে, গত ১৪ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে রয়েছে। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে বার বারই সরকারের পক্ষ থেকে আশার কথা শোনানো হচ্ছে। কিন্তু কোনভাবেই মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে পারছে না সরকার। লাগাম টেনে ধরতে না পারার এই চ্যালেঞ্জের মধ্যেই নতুন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছে অর্থবিভাগ। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কী বলবেন অর্থমন্ত্রী সেটিই এখন দেখার বিষয়।
বাজেটের আকার ও ঘাটতি : অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, নতুন অর্থবছরের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাবনা। এবার বাজেটে ঘাটতিই থাকবে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এই বিশাল পরিমাণ ঘাটতি পূরণে কয়েকটি খাতকে উৎস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে ব্যাংকিং খাত। এই খাত থেকে মোটা দাগে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য বিদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকার সহায়তা পাওয়া যাবে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে ১ লাখ কোটি টাকার প্রকল্প ঋণও রয়েছে। এর পাশাপাশি ব্যাংকবহির্ভূত খাত হিসেবে বিবেচিত সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া হবে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা- নতুন অর্থবছরে মোট রাজস্ব প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে যা ছিল ৫ লাখ কোটি টাকা। রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮ শতাংশ। নতুন রাজস্ব প্রাপ্তির মধ্যে বরাবরের মতো এবারও বেশিরভাগ আয় করার দায়িত্বটি দেওয়া থাকবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে এনবিআরকে রাজস্ব আয়ের টার্গেট দেওয়া হয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। নন-এনবিআর থেকে আসবে আরও ১৫ হাজার কোটি টাকা। আর কর ব্যতীত প্রাপ্তির টার্গেট থাকছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা।
কমে যাচ্ছে রিজার্ভ : উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় পৃথিবীর অনেক দেশ সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, যার ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বব্যাপী সুদের হার বৃদ্ধি পায়। আর উচ্চ মূল্যস্ফীতি রোধে সুদের হার বৃদ্ধি উন্নয়নশীল দেশগুলোর পুঁজি প্রবাহকে দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। এর ফলে একদিকে উন্নয়নশীল দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে এবং নিজস্ব মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটছে। অন্যদিকে বৈদেশিক ঋণের ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। এমনটি উল্লেখ করা হয়েছে সরকারের মধ্য মেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে (এমটিবিএফ)। ]
নতুন অর্থবছরের জিডিপি : আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। যা চলতি অর্থবছরে ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। পরে তা কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হয়। অবশ্য বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে বড়জোর ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রায় কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি প্রক্ষেপণ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
বাজেটের তথ্য মিলবে যেসব ওয়েবসাইটে
‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’ স্লোগানকে সামনে রেখে আজ বৃহস্পতিবার ঘোষণা করা হবে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের বাজেট। বাজেটের সব তথ্য কয়েকটি সরকারি ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে।
এদিন বিকেল ৩টায় জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী। এটি দেশের ৫৩তম, আওয়ামী লীগ সরকারের ২৫তম এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল হাসান মাহমুদ আলীর প্রথম বাজেট।
বাজেট পেশ প্রসঙ্গে এক বিজ্ঞপ্তিতে অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাজেটকে অধিকতর অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে অর্থ বিভাগের ওয়েবসাইট এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইটে সব তথ্য ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল যেকোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পড়তে ও ডাউনলোড করতে পারবেন। পাশাপাশি দেশ বা বিদেশ থেকে ইমেইলের মাধ্যমে বাজেট সম্পর্কে মতামত ও সুপারিশ পাঠানো যাবে।
মন্ত্রণালয় আরও জানায়, বাজেট উপস্থাপনের পরদিন অর্থাৎ আগামীকাল শুক্রবার বিকেল ৩টায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে।
বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকারের ‘ভরসা’ ব্যাংক ঋণ : বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকারের ব্যাংক ঋণনির্ভরতা বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের মতো আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও সরকার বিপুল পরিমাণ ব্যাংক ঋণ করার পরিকল্পনা ঠিক করছে। যা ঘটতির প্রায় ৫৪ শতাংশ এবং মোট বাজেটের ১৭ শতাংশ। আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হচ্ছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার টাকা। বিশাল অংকের এ বাজেটের ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা। যা মোট জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ।
বাজেটের আয়-ব্যয়ের বিশাল ঘাটতি পূরণে প্রধান ভরসাস্থল হিসেবে ব্যাংক খাত বেছে নিয়েছে সরকার। ফলে এবারও ঘাটতি পূরণে ব্যাংক ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নেবে বলে লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। এই অংক চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ হাজার ১০৫ কোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এক ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছিল সরকার। তবে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রায় এটি বাড়িয়ে এক ৫৫ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা ঠিক করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।