আন্তর্জাতিক ডেস্ক : গত পাঁচ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অবস্থান করছেন তিনি। ঠিক কোন ‘ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাসে’ শেখ হাসিনা এই মুহুর্তে ভারতে রয়েছেন, স্পষ্ট করে জানায়নি ভারত।
যদিও শুরুতে ভারত সরকার ইঙ্গিত দিয়েছিল মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপের তৃতীয় কোনও দেশই শেখ হাসিনার চূড়ান্ত গন্তব্য হতে যাচ্ছে, কিন্তু সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়নের কোনও লক্ষণ এখনও দেখা যায়নি।
তবে ভারতে অনেক পর্যবেক্ষকই বলছেন, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে ভারতে লম্বা একটা সময়ের জন্য ‘রাজনৈতিক আশ্রয়ে’ থাকতে হবে শেখ হাসিনাকে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত সরকার এখনও এই ব্যাপারে কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে এখন কী করা হবে, কতদিন ভারতে থাকবেন তিনি এসব বিষয় নিয়ে এখনও অস্পষ্টতা থাকলেও অতীতে কিন্তু বিভিন্ন দেশের একাধিক নেতা, রাজনীতিবিদ বা তাদের পরিবারকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে ভারত।
বাংলাদেশের নেতারা
শেখ হাসিনা নিজেই ১৯৭৫-এ পিতা শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর ব্যক্তিগত জীবনে চরম সঙ্কট অবস্থায় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছিলেন।
সেই যাত্রায় স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে প্রায় দীর্ঘ ছ’বছর ভারতে কাটিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। যদিও নিরাপত্তার স্বার্থে দিল্লির পান্ডারা পার্কে তাদের সেই বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল ভিন্ন নাম ও পরিচয়ে।
এরও কয়েক বছর আগে একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাজউদ্দিন আহমেদ-সহ আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতা ভারতে পালিয়ে চলে এলে তাদেরও আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামদের নেতৃত্বে এরপর গড়ে তোলা হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকার, যার কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো মূলত কলকাতা থেকেই।
১৯৭৫-এ শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন পর বাংলাদেশে জীবন বিপন্ন হলে মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীও ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় পান। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান শহরের একটি সরকারি ‘সেফ হাউসে’ বহু বছর কাটিয়েছিলেন ‘বাঘা সিদ্দিকী’ নামে পরিচিত এই নেতা।
শুধুমাত্র শেখ হাসিনা বা বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতানেত্রীরাই নন, বিভিন্ন সময়ে এবং বিভিন্ন সরকারের আমলে অন্যান্য বহু দেশের অনেক নেতা বা তাদের পরিবারও ভারতে আশ্রয় পেয়েছেন।
দালাই লামা (১৯৫৯)
তিব্বতে চীনা অভিযানের মুখে ১৯৫৯ সালে জন্মভূমি ছেড়ে ভারতে পালিয়েছিলেন তিব্বতী বৌদ্ধদের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামা। যেটা ছিল স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে কোনও বিদেশি ধর্মীয় নেতাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার প্রথম ঘটনা। সেই থেকে আজ ৬৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতেই রয়েছেন দালাই লামা।
ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ তার আকরগ্রন্থ ‘ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী’তে লিখেছেন, “১৯৫৯ সালের মার্চ মাসের শেষ দিনটিতে দালাই লামা ম্যাকমোহন লাইন অতিক্রম করে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ভূখণ্ডের প্রবেশ করেন। তার আগে বেশ কয়েক বছর ধরে তিব্বতের এই ‘ঈশ্বর-রাজা’ লাসা-য় তার পোটালা প্যালেসের সিংহাসনে দিন কাটাচ্ছিলেন চরম অস্বস্তির মধ্যে, কারণ তিব্বতের ওপর চীনের কব্জা ক্রমশ এঁটে বসছিল। একটি সূত্র জানাচ্ছে, তখনই অন্তত পাঁচ লক্ষ চীনা সৈন্য তিব্বতে মোতায়েন ছিল, পাশাপাশি আরও ছিল তার অন্তত দশগুণ হুন বসতি স্থাপনকারী।”
তিব্বতিরা বহুদিন ধরেই সন্দেহ করছিলেন যে তাদের ধর্মগুরুকে চীনারা অপহরণ করার ষড়যন্ত্র আঁটছে, এই ঘটনায় তাদের সেই ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়।
এর ঠিক আগের বছরই (১৯৫৮) পূর্ব তিব্বতের খাম্পা জনজাতি এই চীনা ‘দখলদার’দের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থান করেছিল। খাম্পারা শুরুতে কিছুটা সাফল্য পেলেও চীনা বাহিনী খুব শক্ত হাতে সেই বিদ্রোহ দমন করে এবং এরপর দালাই লামাকে পর্যন্ত নিশানা করার ইঙ্গিত দিতে থাকে।
পরবর্তীতে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু পার্লামেন্টে ঘোষণা করেছিলেন, তিব্বতি ধর্মগুরু দালাই লামাকে ভারত সরকার ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’ দিয়েছে।
মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ্ (১৯৯২)
১৯৮৬ সালে সোভিয়েতের সমর্থনে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ আহমদজাই। প্রায় ছ’বছর প্রেসিডেন্ট পদে থাকার পর ইসলামি মুজাহিদিনরা যখন ১৯৯২ সালের এপ্রিলে কাবুল দখল করে, তখন প্রেসিডেন্ট পদে ইস্তফা দিয়ে নাজিবুল্লাহ ভারতের কাছে আশ্রয় চান, তা মঞ্জুরও হয় সঙ্গে সঙ্গেই।
ভারতের সঙ্গে আফগান রাজনীতিক নাজিবুল্লাহ্-র ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কিশোর বয়স থেকেই, ভারত-শাসিত কাশ্মীরের বারামুলার একটি সেকেন্ডারি স্কুলে তিনি নিজে পড়াশুনোও করেছেন।
তবে ১৯৯২তে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে আসার চেষ্টায় এয়ারপোর্টে আসার পথেই আফগান নিরাপত্তারক্ষীরা নাজিবুল্লাহ্-কে আটকে দেন, তার আর দিল্লির বিমানে চাপা সম্ভব হয়নি।
যদিও এই ঘটনার কয়েক মাস আগেই বিপদ আঁচ করে প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহ্ তার স্ত্রী ও তিন কন্যা সন্তানকে গোপনে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু সেই তথ্য তখন প্রকাশ করা হয়নি। অনেক পরে ভারত সরকার এ তথ্য প্রকাশ করেছিল।
তবে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া সত্ত্বেও ভারতে কখনই আসতে পারেনি নাজিবুল্লাহ্। ১৯৯৬ তে নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের হাত থেকে তালেবান কাবুল দখল করে নেয়ার সময় নাজিবুল্লাহ্কে প্রকাশ্যে নির্যাতন এবং গুলি করে হত্যা করে। তাকে হত্যার পর কাবুলে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের ঠিক বাইরে একটি ল্যাম্পপোস্টের পোল থেকে তার দেহটি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
যদিও তার পরিবারের বাকি সদস্যরা অবশ্য ভারতের আশ্রয়েই নতুন করে নিজেদের জীবন গড়ে তুলতে পেরেছিলেন।
মোহামেদ নাশিদ (২০১৩)
মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট তথা রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট মোহামেদ নাশিদকে ভারত রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিল এক বিচিত্র পরিস্থিতিতে।
মোহামেদ নাশিদ এর আগে ২০০৮ সালে মালদ্বীপে প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গায়ুমের একটানা তিরিশ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশের ক্ষমতায় এসেছিলেন। ২০১২ সালে সে দেশে এক রাজনৈতিক সংকটের জেরে অবশ্য তাকে পদত্যাগ করতে হয়।
অপসারিত প্রেসিডেন্ট মোহামেদ নাশিদের বিরুদ্ধে ২০১৩র ১৩ই ফেব্রুয়ারি সে দেশের আদালত একটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। তবে তাকে গ্রেপ্তার করার আগেই নাশিদ রাজধানী মালে-র ভারতীয় হাই কমিশন ভবনে আশ্রয় নেন।
সে সময়ে মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহামেদ নাশিদকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিল ভারতের মনমোহন সিং সরকার। তবে কয়েক দিন পরেই অভ্যন্তরীণ সমঝোতার ভিত্তিতে নাশিদ গ্রেপ্তার থেকে অব্যাহতি পাওয়ায় তার ভারতে যাওয়ার প্রয়োজন পরেনি।
যদিও পরে ভিন্ন পরিস্থিতিতে মোহামেদ নাশিদকে ২০১৬ তে যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক আশ্রয়ও নিতে হয়েছিল, আবার তিন বছর পর তিনি ফিরে এসেছিলেন মালদ্বীপের রাজনীতিতেও। হয়েছিলেন দেশের পার্লামেন্টের স্পিকারও।
রাজা ত্রিভুবন শাহ (১৯৫০), রাজা জ্ঞানেন্দ্রকে প্রস্তাব (২০০৮)
১৯৫০ সালের নভেম্বরে নেপালের তখনকার মহারাজা ত্রিভুবন বীর বিক্রম শাহ তার ছেলে মহেন্দ্র, সব চেয়ে বড় নাতি বীরেন্দ্র ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে কাঠমান্ডুর ভারতীয় দূতাবাসে আশ্রয় নেন।
নেপালের রাজবংশের সঙ্গে রানাদের (যাদের হাতে ছিল দেশের শাসনক্ষমতা) বহুদিন ধরে চলা সংঘাতের জেরেই একটা পর্যায়ে রাজা ত্রিভুবন ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। রাজা ত্রিভুবন শাহ ভারতের কাছে আশ্রয় চাওয়ায় চটে লাল হয়ে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোহন শামসের জং বাহাদুর রানা।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সিংহ দরবারে জরুরি ক্যাবিনেট বৈঠক ডেকে প্রধানমন্ত্রী রানা সিদ্ধান্ত নেন, ত্রিভুবন শাহ্-র চার বছর বয়সী বাচ্চা নাতি জ্ঞানেন্দ্র – যিনি পিতামহর সঙ্গে ভারতীয় দূতাবাসে যেতে পারেননি – তাকেই নেপালের নতুন রাজা ঘোষণা করা হবে।
এর তিনদিন পর (১০ নভেম্বর ১৯৫০) নেপালের কাঠমান্ডুতে গোওচর বিমানবন্দরে দুটি ভারতীয় এয়ারক্র্যাফট এসে নামে, যাতে করে ত্রিভুবন শাহ ও পরিবারের অন্যরা (শিশু রাজা জ্ঞানেন্দ্রকে ফেলেই) দিল্লিতে রওনা হয়ে যান। ঘটনাচক্রে ওই এয়ারপোর্টের এখন নামকরণ করা হয়েছে রাজা ত্রিভুবন শাহ-র নামেই।
দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও অন্য সরকারি কর্মকর্তারা তাদের স্বাগত জানান। রাজা ত্রিভুবন শাহ ও পরিবারের বাকি সবাইকে ভারত রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়।
তবে রাজা ত্রিভুবন শাহ্-কে মাস তিনেকের বেশি ভারতে থাকতে হয়নি। ১৯৫১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি নেপালের ‘মনার্ক’ বা মহারাজা হিসেবে ত্রিভুবন বীর বিক্রম শাহ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।