রাজশাহী প্রতিনিধি : জাতীয় পরিচয়পত্র, শিক্ষাগত যোগ্যতার সকল সনদ, পাসপোর্ট, ভোটার তালিকা, ফেসবুক-সব কিছুতেই দেওয়া জন্ম তারিখ অনুযায়ী পপি খাতুনের বয়স ২২। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনের আগে রাতারাতি তার বয়স বেড়ে হয়ে যায় ২৬। পপি খাতুন নির্বাচন কমিশনে (ইসি) যেদিন বয়স সংশোধনের আবেদন করেন, তার পরের দিনই বয়স বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
এর দুদিন পর রাজশাহীর পবা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন পপি মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। গত ২৯ মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পপি বিজয়ীও হন। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের আইন অনুযায়ী, ২৫ বছর বয়সের কম কেউ প্রার্থী হতে পারেন না। জন্ম তারিখ সংশোধনের পর ভোটের আগে পপির বয়স বেড়ে দাঁড়ায় ২৬ বছরে।
এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়। এর সূত্র ধরে নির্বাচন কমিশন পপি খাতুনের জাতীয় পরিচয়পত্র কী ভাবে সংশোধন হয়েছে তার তদন্ত শুরু করেছে। এ জন্য তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিচালক (প্রবাসী ও নিবন্ধন) মো. আব্দুল মমিন সরকার। কমিটির সদস্য সচিব জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মুদ্রণ ও বিতরণ শাখার উপপরিচালক (চ.দা) এএস এম ইকবাল হাসান। জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের সহকারী প্রোগ্রামার (উপাত্ত ব্যবস্থাপনা শাখা) মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানকে তদন্ত কমিটির সদস্য রাখা হয়েছে।
গত ১৯ জুন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের পরিচালক (অপারেশন্স) মো. ফরহাদ হোসেন এক চিঠিতে এ কমিটি করে দেন। চিঠির অনুলিপি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর ও শাখায় দেওয়া হয়েছে। রাজশাহী আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বৃহস্পতিবার এ চিঠি হাতে পেয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন। তবে তদন্তের কোনো বিষয়ে তিনি মন্তব্য করেননি।
কমিটির সদস্যরা এই চিঠি প্রাপ্তির ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের তদন্ত শেষ করে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, ‘পপির বয়স বৃদ্ধির ব্যাপারে গত ১১ জুন সংবাদ প্রকাশিত হয়। তার জাতীয় পরিচয়পত্র দ্রুত সংশোধনসহ সামগ্রিক বিষয় তদন্তের জন্য বলা হয়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১১ সালে পপি পঞ্চম শ্রেণি পাস করেন। সে সনদে তার জন্ম তারিখ ২০০৩ সালের ১২ জানুয়ারি। ২০১৭ সালে এসএসসি পাস করেন তিনি। এই সনদে তার জন্মতারিখ ২০০২ সালের ১২ জানুয়ারি। স্কুলের টেবুলেশন শিটেও একই জন্মতারিখ। চলতি বছর সর্বশেষ ভোটার তালিকাতেও তার জন্মতারিখ ২০০২ সালের ১২ জানুয়ারি।
তবে নির্বাচনের আগে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে পপি তার সব সনদে জন্ম তারিখ পরিবর্তন করে ১৯৯৮ সালের ১২ জানুয়ারি করার আবেদন করেন। চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল শিক্ষা বোর্ডের নাম ও বয়স সংশোধন কমিটির সভায় তা পাস হয়। শিক্ষা সনদের বয়স সংশোধনের পর গত ২০ মার্চ জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্ম তারিখ সংশোধনের আবেদন করেন পপি। ৩ এপ্রিল এ আবেদন বাতিল হয়ে যায়। পরে ২৮ এপ্রিল নির্বাচন কমিশনে আরেকটি আবেদন করেন তিনি। এবার পপির আবেদন গ্রহণ করা হয়। পরে বদলে যায় জন্ম তারিখ। নতুন তারিখ অনুযায়ী, ভোটের দিন তার বয়স ছিল ২৬ বছর ৪ মাস ১৭ দিন। আগের জন্মতারিখ অনুযায়ী ২৫ বছর পূর্ণ না হওয়ায় নির্বাচনে অংশ নিতে পারতেন না তিনি।
জন্মতারিখ পরিবর্তনের জন্য পপি নির্বাচন কমিশনে যে কাগজপত্র জমা দিয়েছেন তার নিয়ম অনুযায়ী, জন্মতারিখ সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজের সঙ্গে নিজের এসএসসি সনদ সংযুক্ত করার কথা কিন্তু হযরত আলী নামে একজন শিক্ষার্থীর সনদ সংযুক্ত করেছেন পপি। হযরত আলী ২০১৭ সালে নওহাটা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছেন। হযরত আলীর জন্মতারিখ ২৯ জুন, ২০০১। অথচ এমন ত্রুটিপূর্ণ আবেদন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় গ্রহণ করে পরদিনই (২৯ এপ্রিল) জাতীয় পরিচয়পত্রটি পরিবর্তন করে দেয়। নতুন জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে পেয়েই পপি নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষদিন গত ২ মে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন জমা দেন।
পরে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় নির্ধারিত ফরমে প্রার্থীদের সকল তথ্য নির্বাচন কমিশনে পাঠায়। সেখানে পপির ১৭ ডিজিটের জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বরও আছে। নম্বরটি হলো- ২০০২৮১১৭২৬৫০০০৫৫৯। ১৭ ডিজিটের প্রথম ডিজিট হলো জন্ম তারিখ। সে অনুযায়ী, জাতীয় পরিচয়পত্রেই তার জন্ম সাল ২০০২। সে অনুযায়ী পপির বয়স ২২। তারপরও পপির মনোনয়নপত্র বাতিল করেননি রিটার্নিং কর্মকর্তা। ভোটে জিতে পপি এখন শপথ গ্রহণের অপেক্ষায়।
তবে সংবাদ প্রকাশের পর ১৩ জুন পপি খাতুনের বিরুদ্ধে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন পরাজিত ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী মোসা. চেনবানু। বয়স জালিয়াতি করার অভিযোগ তুলে তিনি পপির প্রার্থিতা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে পপি খাতুনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।