আড়িয়া গ্যারিসনের পতন হয় যে ভাবে
বন্দী হয় ১৮ পাকসেনা
মো: সাজেদুর রহমান সবুজ, শাজহানপুর (বগুড়া) প্রতিনিধি : আগামীকাল ১ এপ্রিল। ১৯৭১ সালের এদিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। সকাল সাড়ে ১০টায় স্থানীয় এলাকাবাসীদের সাথে নিয়ে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলাধীন আড়িয়া গ্যারিসনে আক্রমণ শুরু করেন বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ। দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর লড়াইয়ে পতন ঘটে আড়িয়া গ্যারিসনের।
অপরদিকে পতন ঠেকাতে প্রাণপণ চেষ্টা চালায় পাকবাহিনী। সম্মুখ যুদ্ধ ছাড়াও আকশ থেকে ২ দফা হামলার হামলা চালানো হয় মুক্তিযোদ্ধাদের উপর। তবুও দমেনি বীর বাঙ্গালী। গ্যারিসনের পতন যখন প্রায় নিশ্চিত তখন গ্যারিসনের (সেনা অস্ত্রাগার) অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নূর (মতান্তরে ক্যাপ্টেন নূর এর স্ত্রীর) গুলিতে শহীদ হন বগুড়ার তৎকালীন প্রতিথযশা চিকিৎসক ডা. টি আহম্মেদের ছেলে টকবগে যুবক মাসুদ।
বাংলার দামাল ছেলে শহীদ মাসুদের স্মৃতি রক্ষার্থে স্থানীয়রা আড়িয়া বাজারের নতুন নামকরণ করেন শহীদ মাসুদ নগর। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও মাসুদ নগরের কোন স্বীকৃতি মিলেনি। মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্যবাহী এই স্থানটির স্মৃতি সংরক্ষণে আজও কোন স্থাপনা নির্মিত হয়নি।
স্থানীয় উদ্যোগে একটি শহীদ মিনার নির্মিত হলেও সড়ক উন্নয়ন কাজের জন্য ২০১৮ সালে তা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। তবে শহীদ মাসুদের স্মৃতি রক্ষার্থে আড়িয়া-রহিমাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি শহীদ মাসুদের নামে একটি মিলনায়তনের নামকরণ করেছেন।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ভারত ও পাকিস্তান বিভক্তির পর ১৯৬৬ সালে শাজাহানপুরের আড়িয়া বাজার এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি গ্যারিসন (অস্ত্রাগার) স্থাপন করা হয়। মেশিনগান, স্টেনগান, রাইফেল, কামানসহ ভারি অস্ত্র-শস্ত্রে সমৃদ্ধ করা হয় অস্ত্রাগারটি।
মজুদ করা হয় প্রচুর পরিমাণ গোলাবারুদ। অস্ত্রাগারের নিরাত্তায় গ্যারিসনে কর্মরত ছিলেন সেনা কর্মকতাসহ ৬৫ থেকে ৭০জন সেনাসদস্য। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন বাঙ্গালী। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর যখন সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল তখন থেকেই শাজাহানপুরের মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিকামী মানুষ, আওয়ামীলীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মিরা আড়িয়া গ্যারিসনের পতনের পরিকল্পনা করছিলেন।
পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন তৎকালীন জেলা আওয়ামীলীগের দপ্তর সম্পাদক মরহুম আয়েন উদ্দিন আহম্মেদ মাস্টার, মরহুম মোবারক আলী মাস্টার, শহীদ মনিরুজ্জামান, ছমির উদ্দিন মাস্টার, মরহুম আশরাফ আলী মাস্টার, আমরুল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম রাজীবুল ইসলাম, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নজিবুর রহমান সরকার, আব্দুল জলিল, নূর উদ্দিন মাস্টার, আব্দুর রশিদ, মনিরুজ্জামান বাচ্চু, দবির উদ্দিন, খয়বর হোসেন, তোতা মিয়া, আব্দুল হাদি সরকার, ইউনুস আলী মাস্টার, বিরাজুল মাস্টার, মরহুম মোকছেদ আলী, সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম আব্দুল হাকিমসহ আরও অনেকে। পরিকল্পনা মোতাবেক টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন, গাছ কেটে রাস্তায় বেড়িকেড দেয়া, খাদ্য অবরোধসহ নানা রকম কর্মসূচি হাতে নেন তারা।
অবশেষে ১ এপ্রিল’৭১ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বগুড়া পুলিশ লাইনে কর্মরত হাবিলদার আব্দুল লতিফ পাক সরকারের প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগদেন। তার নেতৃত্বে ডা. টি আহম্মেদের ছেলে মাসুদ, বগুড়া-৭ আসনের বর্তমান সাংসদ ডা. মোস্তফা আলম নান্নুুসহ ৫০-৬০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি সশস্ত্র দল আড়িয়া বাজার এলাকায় পৌঁছে।
দলটির উপস্থিতিতে স্থানীয় সাধারণ মানুষও তাদের সাথে যোগ দেন। শুধুু তাই নয়, আড়িয়া গ্যারিসনে কর্মরত থাকা ৪০-৫০ জন বাঙালি সেনা সদস্য পাকবাহিনীর সাথে বিদ্রোহ ঘোষণা করে অস্ত্রসহ গ্যারিসন থেকে বেড়িয়ে আসেন এবং যোগদেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে। শুরু হয় প্রচন্ড লড়াই। তারকাটা দিয়ে ঘেরা গ্যারিসনকে ধ্বংস করতে চালানো হয় তীব্র আক্রমণ। যুদ্ধ চলে একটানা আড়াই ঘণ্টা।
পতনের পূর্ব মুহূর্তে শেষ রক্ষা পেতে গ্যারিসন থেকে ওয়্যারলেসে পাকবাহিনীর সদর দপ্তরে ম্যাসেজ পাঠানো হয়। ম্যাসেজ পাওয়া মাত্রই পাকবাহিনীর বোমারু বিমান আড়িয়া বাজারের আকাশে ২ দফা হানা দেয়। বিমান থেকে নিক্ষেপ করা হয় কয়েকটি শক্তিশালী বোমা। প্রকম্পিত হয় আড়িয়া বাজারের আকাশ-বাতাসসহ পুরো জনপদ।
প্রাণ বাঁচাতে হাজারো মানুষ এলোপাথারি ছুটাছুটি শুরু করে। কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেনটি। জীবন বাজি রেখে তারা যুদ্ধ চালিয়ে যান। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয় পাকবাহিনীর ৫ সেনা সদস্য। গ্যারিসনের পতন যখন প্রায় নিশ্চিত ঠিক তখন বিজয় উল্লাসে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে তারকাটা ঘেরা প্রাচীর বেয়ে উপরে উঠেন ডা. টি, আহম্মেদের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুদ।
তিনি যখন প্রাচীর থেকে লাফিয়ে নিচে নামার চেষ্টা করছিলেন তখন ওই গ্যারিসনের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নূরের (মতান্তরে ক্যাপ্টেন নূরের স্ত্রীর) গুলিতে ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন মাসুদ। তার বুকের রক্তে রঞ্জিত হয় আড়িয়া বাজার। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী হয় সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন নূরসহ ১৮ সেনা সদস্য।
পতন ঘটে ঐতিহাসিক আড়িয়া গ্যারিসনের। গ্যারিসন পতনের নেপথ্যের কাহিনী সম্পর্কে স্থানীয়রা আরও জানান, ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর। আড়িয়া-রহিমাবাদ স্কুল মাঠে ২১ বার তোপধ্বনি দিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন নজিবুর রহমান সরকার। তাকে সহায়তা করেন আহম্মেদুর রহমান সরকার, আড়িয়া পালপাড়ার ভূপেন পাল, জামুন্নার মোবারক মাস্টারসহ স্থানীয় অনেকে।
আড়িয়া গ্যারিসনের পতন দিবসের মিছিলে সরাসরি অংশ নেওয়া বগুড়া-৭ আসনের সাংসদ অধ্যাপক ডা. মোস্তফা আলম নান্নু জানিয়েছেন, শহীদ মাসুদসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আড়িয়া গ্যারিসনের পতন দিবসের চেতনা নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে মাসুদ নগরে একটি স্মৃতি সৌধ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।