গুলিবিদ্ধ চোখের অপারেশনের টাকা জোগারে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন আলিফ
স্টাফ রিপোর্টার : কোটা সংস্কার ও পরবর্তীতে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন চলাকালে পুলিশের সাথে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং পুলিশের ছোড়া বুলেট ও রাবার বুলেটের আঘাতে গুরুতর আহতদের মধ্যে এখনও বগুড়াসহ আশপাশের জেলার ১৯ জন শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
আহতদের মধ্যে শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ রয়েছেন। যাদের বেশিরভাগের শরীরেই রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়েছে। বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে এসব তথ্য জানাগেছে। বগুড়া সদরের কুকরুল গ্রামের ওয়াজেদ আলীর ছেলে আকবরিয়া প্যাকেজিং এর অস্থায়ী শ্রমিক মো: সবুজ(৪০) জানান, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর শুনে শহরে আনন্দ মিছিলে যোগদান করেন। বিকেল ৩টার দিকে ঝাউতলা এলাকায় তার পায়ে হাঁটুর নিচে দুইটি গুলি বিদ্ধ হলে তিনি গুরুতর আহত অবস্থায় বগুড়া শজিমেক হাসপাতালে ভর্তি হন।
তিন মেয়ে সন্তানের জনক সবুজ দীর্ঘদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকায় তার আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। এতে সংসার চালাতে গিয়ে ইতিমধ্যেই তাকে টাকা ধার করতে হয়েছে। বগুড়া শহরতলীর মাটিডালী বেইলী ব্রিজ সংলগ্ন করতোয়া পাড়ার সিদ্দিক মিয়ার ছেলে ভ্যান
চালক মো: নূর আলম (৩৮) জানান, গত ৫ আগস্ট আনন্দ মিছিল করতে অনেকের সাথে তিনিও শহরে আসেন। দুপুরের দিকে বগুড়া সদর থানা মোড় এলাকায় পুলিশের ছড়ড়া গুলি তার শরীরে বিদ্ধ হয়। তাকে প্রথমে টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখান থেকে বগুড়া শজিমেক হাসপাতালে রেফার্ড করা হলে সেই থেকে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
দীর্ঘদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকায় তার দুই ছেলেসহ স্ত্রী’র সংসারের খরচ কোনমতে চালিয়ে আসছেন তার শ্রমিক বাবা সিদ্দিক মিয়া। সংসারের খরচ ও হাসপাতালে যাতায়াতের খরচ বহন করতে গিয়ে তার বাবাকে ইতিমধ্যে অনেক টাকা ধার করতে হয়েছে।
শজিমেক হাসপাতাল চত্বরে দেখা হয় বগুড়া শহরের উত্তর চেলোপাড়া এলাকার মৃত লুৎফর রহমানের ছেলে ফিরনি বিক্রেতা মো: আলিফ (৩৮) এর সাথে। গত ৪ আগস্ট শহরের তিন নং রেলগেট এলাকায় তিনি পুলিশের ছোরা রাবার বুলেটের আঘাতে গুরুতর আহত হন। তার ডান চোখে দুইটি, নাকে একটি ও মাথায় দু’টি গুলিবিদ্ধ হলে তাকে প্রথমে একটি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়।
পরে চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. বিপুল চন্দ্র রায়’র চেম্বারে গেলে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ প্রদান করেন। এ অবস্থায় গত ৭ আগস্ট তিনি ঢাকা ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে যান। সেখানে ঐ দিনই তার চক্ষু অপারেশন করে একটি রাবার বুলেট বে’র করা হয়। এতে তার প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
এরমধ্যে স্থানীয় কাউন্সিলর পরিমল চন্দ্র দাস ১০ হাজার টাকা প্রদান করেন ও বাঁকি টাকা তাকে ধার করতে হয়েছে। এ ছাড়াও তার ডান চোখে একটি, নাকের উপর একটি এবং মাথায় দু’টি রাবার বুলেট বিদ্ধ রয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বাঁকি বুলেট বের করতে অপারেশনসহ অন্যান্য খরচ পরবে প্রায় ৪৪ হাজার টাকা। অপারেশনের ঐ টাকা জোগার করতে তিনি বিভিন্নজনের কাছে ধর্ণা দিয়ে যাচ্ছেন। টাকার জোগার করে অপারেশন করাতে না পারলে তার চোখের বড় ধরণের ক্ষতি হতে পারে বলে তিনি জানান।
শজিমেক হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার বোহাইল গ্রামের চাঁন মিয়ার ছেলে সৈয়দ আহম্মেদ কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সৈকত (২০)। গত ২১ জুলাই আন্দোলনে যোগ দিতে শাজাহানপুর থেকে তিনি বগুড়ায় আসছিলেন।
ঐদিন যানবাহন বন্ধ থাকায় পায়ে হেঁটেই তিনি বগুড়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। পথে শাজাহানপুর থানা পার হয়ে আসার পর পুলিশ ধাওয়া দেয়। ধাওয়া খেয়ে দৌড় দিতে দিতে তিনি পেছন ফিরে পুলিশের অবস্থান দেখার চেষ্টা করলে সামনে থেকে একটি সিএনজি চালিত অটোর সাথে ধাক্কা লাগে। এ সময় ঐ অটোটি তাকে বেশ কিছুদূর টেনে নিয়ে গেলে তিনি গুরুতর আহত হন।
তার হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ছিলে রক্তাক্ত হয়ে পড়লে ঐ দিনই তাকে শজিমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেই থেকে তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এ ছাড়াও গুলিবিদ্ধ হয়ে শজিমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বগুড়ার গাবতলী উপজেলার টুটিয়ার ঘোন এলাকার সোনা মিয়ার ছেলে এইচএসসি পরীক্ষার্থী সুমন (১৯), ধুনটের বিশ্ব হরিগাছা এলাকার সলিম উদ্দিনের ছেলে আব্দুল মজিদ (২৬), একই উপজেলার সারদহ এলাকার বাবু সরকারের ছেলে হোসাইন (১৮), নুসরতপুরের আমজাদ হোসেনের ছেলে সোহাগ (৩৩)। গাবতলী উপজেলার মহিষাবান গ্রামের ওবায়দুল সরকারের ছেলে মাদ্রাসার ছাত্র জেহাদুল ইসলাম জেহাদ (১৮)।
জেহাদ জানান, গত ১৮ জুলাই শহরের কালিতলা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। এরপর প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছিলেন। পরদিন ১৯ জুলাই পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং এরপর তাকে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়। গত ৬ আগস্ট তিনি ছাড়া পেয়ে পরদিন শজিমেক হাসপাতালে ভর্তি হন। আরও ভর্তি রয়েছেন শহরের সাতমাথার বিসমিল্লাহ ফল ভান্ডার নামে প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ী গাবতলীর জয়ভোগা গ্রামের মৃত চুন্নু প্রামানিকের ছেলে শিপন প্রামাণিক (৩৫)।
এইচএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তির জন্য অপেক্ষারত শাজাহানপুর উপজেলার জামুন্না গ্রামের জাহিদুল ইসলামের ছেলে জোবায়ের হোসেন (২০), গাবতলীর রামেশ্বরপুর এলাকার নুরুন্নবীর ছেলে কামরুল ইসলাম (১৯), বগুড়া সদরের ডাকুরচক এলাকার হেলাল উদ্দিনের ছেলে রোকন ইসলাম (১৫), মাদারীপুরে আরএফএল’এ কর্মরত গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার কিশমত দশনিয়া এলাকার আবুল কাসেমের ছেলে হাবিবুর রহমান (২৭), একই জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার শিবপুর পাঁচগাছি বাজারের জহুরুল ইসলামের ছেলে নির্মাণ শ্রমিক মোহন ইসলাম (১৮), নওগাঁর নজিপুরের জাকির হোসেনের ছেলে আল নাফিজ (২৪)।
নফিজ নজিপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার রতনপুর গ্রামের নওয়াব আলীর ছেলে বগুড়া শহরের গালাপট্টি এলাকার চা বিক্রেতা আবু সাইদ (২৪), জয়পুরহাট কড়ই নুরুলহুদা কামিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী মোসলেম উদ্দিনের ছেলে তারেক রহমান (২১) ও জয়পুরহাট বটতলী বাজার এলাকার আজিজুল হকের ছেলে এইচএসসি পরীক্ষার্থী সাব্বির হোসেন (১৮)।
বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ পরিচালক ডা. মো: আব্দুল ওয়াদুদ জানান, কোটা বিরোধী ও সংস্কার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধসহ বিভিন্নভাবে আহত রোগিদের মধ্যে আজ বুধবার (১৪ আগস্ট) সকাল পর্যন্ত অত্র হাসপাতালে ১৯ জন ভর্তি ছিল। এ পর্যন্ত উক্ত ঘটনায় মোট ২০৯ জন ভর্তি হয়।
এর মধ্যে অনেকে চিকিৎসা নিয়ে চলে গেলেও এখনও বগুড়াসহ আশে পাশের এলাকার আহত অনেকে আসছে। এরা আগে বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা নিলেও অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাদেরকে এই হাসপাতালে আসতে হচ্ছে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।