নজরুল ইসলাম আকন্দ, ক্ষেতলাল (জয়পুরহাট) : জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার কানাইপুকুর গ্রামের মন্ডলপাড়ার পুকুর পাড়ে কয়েক হাজার শামুকখোল পাখির আশ্রয়স্থল এই গ্রামের পরিচিতি এনে দিয়েছে দেশে। তারা এই পাখির উপস্থিতিকে সৌভাগ্য হিসেবে দেখছে। ক্ষেতলাল উপজেলা সদর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দুরত্বের এই গ্রামে পাখি দেখতে বিভিন্ন জায়গা থেকে আসে দর্শনার্থীরা। এছাড়া ক্ষেতলাল উপজেলার কাজীপাড়া মহব্বতপুর গ্রামে শামুকখোল পাখি বাস করে। সেখানেও দর্শনার্থিরা পাখি দেখতে ভিড় জমায়।  

উইকিপিডিয়া সুত্রে জানা যায়, এশীয় শামুকখোল নামের এই পাখিকে ইংরেজিতে এশিয়ান ওপেন বিল। এর বৈজ্ঞানিক নাম আনাস্টোমাস ওসিটানস । বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ করলে দাঁড়ায় মূখ খোলা বা হাই তোলা। এজন্য পাখিটিকে হাইতোলা বা মূখখোলা পাখিও বলা হয়ে থাকে। লম্বা পা, লম্বা ঠোঁটের বিশেষ এই পাখিটির উপস্থিতি রয়েছে বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও দক্ষিণ  ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কোন কোন অংশে। তবে কয়েক দশকে এদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে।

পাখিটি মূলত শামুক-ঝিনুক খেয়ে জীবন ধারণ করে। এর চোখ সাদা, ধূসর বা হলদে-বাদামি। চোখের চারিদিকের চামড়া পলকহীন। বড়সড় ডানার কিছু অংশ ও লেজ কালো। লম্বা ভারী ঠোঁট, নিচের ঠোঁট বেশি বাঁকা হয়ে ওপরের ঠোঁটের ডগার সঙ্গে মিলে ফাঁকের সৃষ্টি হয়েছে। শামুক-ঝিনুক ধরতে এতে তাদের সুবিধা হয়। পা লম্বা, পায়ের পাতা অনুজ্জল মেটে রঙের।

প্রজনন মৌসুম ছাড়া প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহ ধূসর-সাদা। এই পাখির বিচরণ হাওর, বিল, মিঠাপানির জলা, হ্রদ, ধানক্ষেত, উপকূলীয় প্যারাবন ও নদীর পাড়ে। সাধারণত এরা থাকে ঝাঁকবেঁধে। খাবারের অভাব না হলে এরা এক জায়গা থেকে অন্যত্র বাসা বদল করে না। এরা খাদ্যের সন্ধানে বাসা ছেড়ে বের হয় ভোরে।  সূর্য পশ্চিমে হেলতে শুরু করলে বাসায় ফেরে। রাতভর চলে তাদের কলকাকলি। 
বর্ষাকালের শেষ দিকে মূলত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস এদের প্রজনন মৌসুম। যে বছর খরা হয় সে বছর এরা সাধারণত প্রজনন করে না। গাছের ডালপালা দিয়ে বাসা বাঁধে এরা। বাসা বানানো শেষে স্ত্রী পাখি ডিম পাড়ে, সংখ্যায় দুই থেকে পাঁচটি। ডিমের রঙ সাদা। স্ত্রী ও পুরুষ দু’জনেই তা দেয় ডিমে। প্রায় ২৫ দিনেই ডিম ফুটে বের হয় ছানা।

কানাইপুকুর গ্রামের গাছগুলোতে শুধু শামুকখোলই নয় মাছরাঙা, পানকৌড়ি, রাতচোরা ও চড়ুইপাখি বাসা বেঁধে আছে। গ্রামের মানুষের ভালবাসা আর মমত্বে নিরাপদে বাস করছে পাখিগুলো। বহিরাগত শিকারি অথবা গ্রামের দুষ্ট ছেলেরা এই পাখিগুলোর যেন ক্ষতি করতে না পারে সেজন্যও সতর্ক থাকেন গ্রামবাসী। সারাদিন পাখির কিচির-মিচিরে কান পাতা দায় হলেও গ্রামের সব বয়সের মানুষের ভালবাসা পেয়ে প্রজননের মাধ্যমে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে পাখির সংখ্যা।

কানাইপুকুর গ্রামের গৃহবধূ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মহসিনা বেগম বলেন, ‘পাখিদের আবাসস্থলকে নিরাপদ রাখতে তারা পুকুর পাড়ের গাছগুলো কখনও কাটবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ফলে যতদিন ইচ্ছে পাখিরা সেখানে নিরাপদে বাস করতে পারবে। নিরাপত্তা দিতে তাদের পাশাপাশি গ্রামের মানুষরাই পাখিগুলোকে আগলে রেখেছেন।

ওই গ্রামের বাসিন্দা এবং পুকুরের মালিক জাহাঙ্গীর হোসেন মন্ডল বলেন, ‘গ্রামবাসীর অকৃত্রিম ভালবাসা পেয়ে পাখিগুলো কয়েক বছর ধরে নিরাপদেই আছে। তবে সরকারিভাবে পাখি কলোনি হিসেবে ঘোষণা করলেও তেমন কোন নজরদারি নেই। তাই সরকারি নজরদারি বৃদ্ধি পেলে পাখিগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে তাদের আর ভাবতে হবে না’।

ক্ষেতলাল উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ড. পলাশ চন্দ্র রায় বলেন নিরাপত্তার কথা ভেবে পাখির জন্য এই এলাকাকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করে উপজেলা প্রশাসন। পাখির রোগ বালাই দেখা দিলে তাৎক্ষনিক ভাবে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করা হয়। এছাড়া পাখি শিকার না করার জন্য সেখানে স্থানীয় লোকজন নিয়ে সভা করা হয়। কানাই পুকুর গ্রামে শামুকখোল পাখির অভয়াশ্রম বৃহৎ পরিসরে সংরক্ষণের চেষ্টা চলছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. আনন্দ কুমার বলেন, ‘এ ধরণের পাখি সাধারণত শীত প্রধান সাইবেরিয়া, সুইডেন, নরওয়ে ইত্যাদি দেশ থেকে আসে। শীত চলে গেলে আবার তারা ফিরে যায়। তবে আমাদের দেশের পাখিগুলো এশিয়ান অঞ্চলের হওয়ায় এদের নাম এশিয়া শামুকখোল।

এই পাখিগুলো স্থায়ীভাবে বাসা বেঁধে কোথাও প্রজনন করছে এমন ঘটনা বিরল হলেও কানাইপুকুর গ্রামে ঘটেছে ব্যতিক্রম ঘটনা। এটি সম্ভব হয়েছে পাখির প্রতি গ্রামবাসীর অকৃত্রিম ভালবাসা ও মমত্ববোধ আর খাদ্য নিশ্চয়তার কারণে।