ভিডিও

বগুড়ায় বাড়ছে বাল্যবিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ

সরকারি-বেসরকারি সব উদ্যোগ ব্যর্থ

প্রকাশিত: মার্চ ১৫, ২০২৪, ১১:০৮ রাত
আপডেট: মার্চ ১৬, ২০২৪, ১২:১৫ রাত
আমাদেরকে ফলো করুন

নাসিমা সুলতানা ছুটু : বগুড়া শহরের স্বনামধন্য এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাইশাকে (ছদ্ম নাম) বিয়ে দিতে বাধ্য হয় তার বাবা। মাইশার মা ছিলো না। বাবাও সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। বাসায় কেউ না থাকার সুযোগে মাইশার সঙ্গে তার দূর সম্পর্কের এক ভাইয়ের প্রেমের সম্পর্ক হয়।

মাইশার বাবা যখন জানতে পারেন, তখন পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গড়ায় যে বিয়ে না দিলে মেয়ের জীবন নিয়ে তাকে শঙ্কায় পড়তে হবে। তাই তড়িঘড়ি করে মাইশার বাবা তার অন্য এক আত্মীয়ের বাড়িতে মেয়েকে নিয়ে বয়স বাড়িয়ে ১৮ বছর দেখিয়ে বিয়ে দেন।

আঠারো বছরের দুলালী এখন দুই সন্তানের মা। পাঁচ বছর আগে দুলালীর বয়স যখন ১৩ বছর তখন তার বাবা-মা দুলালীকে বিয়ে দেন। মা অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করতেন। শ্বাসকষ্টের রোগী বাবা কখনও বসে থাকতেন, তো কখনও ভাড়ায় চালিত ভ্যান চালাতেন।

পঞ্চম শ্রেণি পাশের পর দুলালীকে আর স্কুলেও ভর্তি করাননি বাবা-মা। বিনামূল্যে বই দিলেও তো স্কুলের বেতনসহ আরও অন্যান্য খরচ রয়েছে। গরিব বাবা-মা’র পক্ষে এত খরচ চালানো সম্ভব নয়। মেয়ে বড় হয়েছে তাই বাড়িতে রেখে মায়ের পক্ষে বাইরে যেয়ে কাজ করাও সম্ভব নয়। তাই ভালো সমন্ধ পাওয়ায় দুলালীকে তার বাবা-মা বিয়ে দেন।

মাইশা বা দুলালীর মত অনেক কিশোরীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে কেউ প্রেমের সম্পর্ক গড়ে নিজে থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিয়ে করছে, আবার কাউকে বাবা-মা নানা কারণে বিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। বাল্যবিবাহ বন্ধে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও দেশে বাল্য বিবাহ কমার পরিবর্তে দিন দিন বাড়ছে। মহামারী করোনার পর থেকে যেন কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না বাল্যবিয়ে। একইভাবে বাড়ছে তালাকের হারও।


বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী গত ৫ বছরের পরিসংখ্যানে এই চিত্র উঠে এসেছে। সম্প্রতি বিবিএস’র বাল্যবিবাহ ও তালাকের উপর করা জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যাওয়া কিশোরীদের উপর করা জরিপে উঠে এসেছে পাঁচ বছরের মধ্যে বাল্য বিবাহ সবচে বেশি হয়েছে ২০২২ সালে।

ওই বছর প্রতি হাজারে ৬ দশমিক ৫ ভাগ বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। এই হার শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি। ওই বছর গ্রামে বাল্যবিয়ের হার ছিলো ৬ দশমিক ৯ ভাগ এবং শহরে ছিল ৫ দশমিক ৩ ভাগ। ২০২১ সালে দেশে বাল্য বিয়ের হার ছিলো ৪ দশমিক ৭ ভাগ। গ্রামে হার ছিলো ৫ দশমিক ২ ভাগ এবং শহরে ৪ দশমিক ৬ভাগ।

এর আগের বছর ২০২০ সালে বাল্য বিয়ের হার ছিলো ৪ দশমিক ৯ ভাগ। ওই বছর গ্রামে ছিলো ৫ দশমিক ২ ভাগ এবং শহরে ছিলো ৪ দশমিক ২ ভাগ। করোনার আগে ২০১৯ সালে দেশে বাল্য বিয়ের হার ছিলো ৬ দশমিক ২ ভাগ। গ্রামে  ছিলো ৬ দশমিক ৮ ভাগ এবং শহরে ৬ দশমিক ৫ ভাগ। ২০১৮ সালে দেশে বাল্য বিয়ের হার ছিলো ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। গ্রামে ছিলো এই হার ৪ দশমিক ৮ ভাগ এবং শহরে ৪ দশমিক ৪ ভাগ।

অপরদিকে বিবিএস’র করা ওই জরিপে দেখা গেছে ১৮ বছর পূর্ণ হবার আগেই বিয়ে হয়ে যাওয়া কিশোরীদের সংখ্যা বাড়ছে। ২০২২ সালে প্রতি হাজারে ৪০ দশমিক ৯ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের এই হার আরও ভয়াবহ। ওই বছর শহরাঞ্চলে ৩৪ দশমিক ৯ ভাগ এবং গ্রামে ৪২ দশমিক ৯ ভাগ নারীর বিয়ে হয়েছে।

২০২১ সালে দেশে ৩২ দশমিক ৪ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয়েছে এরমধ্যে শহরে ২৮ দশমিক ২ ভাগ এবং গ্রামে ৩৩ দশমিক ৮ ভাগ বাল্য বিয়ে হয়েছে। ২০২০ সালে দেশে ৩১ দশমিক ৩ ভাগ বাল্য বিয়ে হয়েছে। এরমধ্যে শহরে ২৭ দশমিক ৬ ভাগ এবং গ্রামে ৩৪ দশমিক ৬ ভাগ। ২০১৯ সালে দেশে ৪১ দশমিক ১ভাগ বাল্য বিয়ের মধ্যে শহরাঞ্চলে হয়েছে ৩৫ ভাগ এবং গ্রামাঞ্চলে হয়েছে ৪৬ দশমিক ৮ভাগ।

২০১৮ সালে দেশে প্রতি হাজারে ৩০ শতাংশ বাল্য বিয়ের মধ্যে শহরাঞ্চলে হয়েছে ২৭ দশমিক ১ ভাগ এবং গ্রামাঞ্চলে হয়েছে ৩২ দশমিক ৭ ভাগ। বাল্যবিয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশে বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদের বা তালাকের হার।

বিবিএস’র করা ওই জরিপে দেখা গেছে ৫ বছরের মধ্যে সবচে বেশি তালাকের ঘটনা ঘটেছে ২০২২ সালে। বিবিএস’র ওই জরিপে দেখানো হয়েছে বাল্যবিয়ের মত তালাকের ঘটনাও শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামেই বেশি ঘটছে।

২০২২ সালে প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৪ ভাগ তালাকের ঘটনা ঘটেছে। ২০২১ সালে দেশে ০ দশমিক ৭ ভাগ, ২০২০ সালে ০দশমিক ৮ ভাগ, ২০১৯ সালে ১ ভাগ এবং ২০১৮ সালে ০ দশমিক ৯ভাগ তালাকের ঘটনা ঘটেছে।

বগুড়া জেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোঃ শহীদুল ইসলাম জানান, করোনার পর থেকেই বাল্যবিয়ের সংখ্যা বেড়ে গেছে। দীর্ঘ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে হত। সে সময় বাধ্য হয়েই একেবারে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে সবখানেই প্রত্যেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের হাতে স্মার্ট ফোন তুলে দেন।

সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েরা হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে বিয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও তারা নিয়ে ফেলে। এছাড়া রয়েছে বাবা-মা’র অসেচতনতা। অসেচতনার কারণেও অনেক সময় ছেলে-মেয়েরা ভুল করে বসে। বাল্যবিয়ে বাড়লে স্বাভাবিকভাবে বিচ্ছেদ বা তালাকের ঘটনাও বেশি হবে।

বগুড়া সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার ফিরোজা পারভীন বলেন, মূলত: কোভিডের পর থেকেই বাল্যবিয়ে বেড়েছে এবং এখনও সেই হার চলে আসছে। গ্রামে বাল্যবিবাহ বাড়ার মূল কারণ দারিদ্র্যতা ও অভিভাবকদের অসচেতনতা। মেয়ে একটু বড় হলেই বাবা-মা মেয়েকে বোঝা ভেবে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করেন। ভাবেন যত দ্রুত মেয়েকে বিদায় করা যায়, ততই মঙ্গল।

আর শহরাঞ্চলের বাল্যবিয়ের জন্য মূল দায়ী সোস্যাল মিডিয়া। সোস্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন অ্যাপ ব্যাবহার করে এখন ছেলে মেয়েরা একে অপরের কাছাকাছি চলে আসছে এবং বিয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে অভিভাবকদের অমতে বিয়ে করছে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য অভিভাবকদের যেমন সচেতন হতে হবে পাশাপাশি অভিভাবক সমাবেশসহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মকান্ড বাড়াতে হবে।

তালাকের ক্ষেত্রেও গ্রামে যৌতুক, দারিদ্র্যতা ও অসচেতনতাকে তিনি দায়ী করেন। আর শহরাঞ্চলে মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা ও পুরুষদের মাদকাসক্ত হয়ে ওঠা অনেক সময় কারণ হয়ে দাঁড়ায় বলে তিনি জানান।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS