রাজশাহী ও গোদাগাড়ী প্রতিনিধি : এক কিশোরকে তুলে নিয়ে মাদক দিয়ে চালান দেওয়ার ভয় দেখিয়ে দুই লাখ টাকা দাবির ঘটনায় রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলী পুলিশ ফাঁড়ির চার সদস্যকে পুলিশ লাইনে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় গিয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানাভুক্ত এক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তারের পর ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগে গোদাগাড়ী থানা পুলিশের পাঁচ কর্মকর্তাসহ মোট ছয়জনকে লাইনে ক্লোজড করা হয়েছে। ফলে পৃথক ঘটনায় এক রাতে গোদাগাড়ী থানা ও অধীনন্ত প্রেমতলী ফাঁড়ি থেকে মোট ১০ জন পুলিশকে ক্লোজড করা হলো।
প্রথম ঘটনায় প্রত্যাহার হওয়া পুলিশ সদস্যরা হলেন- প্রেমতলী পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের উপ-পরিদর্শক (এসআই) রেজাউল করিম, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আনোয়ারুল ইসলাম, কনস্টেবল রেজাউল ইসলাম ও মিলন হোসেন। গত রোববার বিকেলে তাদের প্রত্যাহারের আদেশ দেন রাজশাহীর পুলিশ সুপার মো. সাইফুর রহমান। প্রত্যাহার হওয়া পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু করা হয়েছে।
অভিযোগে জানা গেছে, শনিবার রাত আনুমানিক সাড়ে ৮টায় গোদাগাড়ী উপজেলার গোগ্রাম ইউনিয়নের গোগ্রাম থেকে কিশোর সোহানুর রহমান সোহানকে (২১) সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে যায় প্রেমতলী পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের চার পুলিশ সদস্য।
সোহান গোগ্রাম এলাকার ব্যবসায়ী মর্তুজা আলীর ছেলে। অভিযোগ মতে, এ পুলিশ দলের নেতৃত্বে ছিলেন এসআই রেজাউল করিম। পুলিশ সদস্যরা সোহানকে গোগ্রাম থেকে তুলে প্রেমতলী পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের পেছনে পদ্মা নদীর পাড়ে নিয়ে যায়। আইপিএল জুয়ায় বিপুল টাকা কামানোর অভিযোগ এনে ছেলেকে ছাড়াতে সোহানের বাবার কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করে পুলিশ।
টাকা না দিলে হেরোইনের মামলা দিয়ে চালান করার ভয় দেখানো হয়। সোহানের হাতে পরানো হয় হাতকড়া। এদিকে পুলিশ দলের সদস্যরা সোহানকে পদ্মার ধারে আটকে রেখে এএসআই আনোয়ারুল ইসলাম টাকা নিতে গোগ্রাম চলে যান সোহানের বাবার কাছে।
এ সময় গ্রামবাসী একজোট হয়ে আনোয়ারুল ইসলামকে আটক করে সোহানকে ফেরত দেওয়ার দাবি করেন। খবর পেয়ে বাকি তিন পুলিশ সদস্য রাত আনুমানিক সাড়ে ১১টার দিকে সোহানকে বসন্তপুরের একটি ফাঁকা সড়কে ছেড়ে দিয়ে যায়। সোহান তার পরিবারের সাথে ফোনে কথা বললে আটক পুলিশ কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলামকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ছাড়া পাওয়ার পর সোহান জানায়, তাকে ছেড়ে দেওয়ার আগে পুলিশ সদস্যরা তার মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে বিকাশের পিন দিয়ে কয়েক হাজার টাকা তুলে নেয়। এদিকে ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ পেয়ে ঘটনাটি তদন্ত করেন গোদাগাড়ী সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার সোহেল রানা।
প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় রোববার রাতে চার পুলিশ সদস্যকে পুলিশ লাইনে ক্লোজড করার নির্দেশ দেন রাজশাহীর পুলিশ সুপার মো. সাইফুর রহমান। এবিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহীর পুলিশ সুপার বলেন, অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা মেলায় প্রেমতলী তদন্তকেন্দ্রের চার পুলিশকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে একটি মামলা করেছে।
অন্যদিকে নিজ থানা সীমানার বাইরে গিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কোদালকাটি চর থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার মাদক ব্যবসায়ী আব্দুস সামাদকে গ্রেপ্তার করে গোদাগাড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আকরাম হোসেনের নেতৃত্বে ছয় পুলিশের একটি দল। রোববার রাত আনুমানিক সাড়ে ৯টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার সীমান্তবর্তী কোদালকাটি চর এলাকায় অভিযান চালিয়ে বাইদুল ইসলামের ছেলে আন্তঃদেশীয় মাদক ব্যবসায়ী আব্দুস সামাদকে গ্রেপ্তার করে।
সামাদের বিরুদ্ধে একডজন মাদকের মামলা রয়েছে দেশের বিভিন্ন থানায়। কয়েকটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানায়। জানা গেছে, সামাদকে গ্রেপ্তারের পর পদ্মার চরের একটি বাগানের মধ্যে আসামিকে রেখে অপেক্ষা করতে থাকেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এক পর্যায়ে গোদাগাড়ীর এসব পুলিশ কর্মকর্তা সামাদকে ছেড়ে দেন।
জানা গেছে, এর আগে সামাদকে গ্রেপ্তারের পর তাকে ছাড়াতে তদবির শুরু করেন গোদাগাড়ী পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিম। সামাদকে ছাড়তে পুলিশের দলটি তিন লাখ টাকা দাবি করেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতা নাসিম দুই লাখ টাকা দেবেন পুলিশকে জানান। কিন্তু পুলিশ সদস্যরা তিন লাখ টাকা না পেলে ছাড়বেন না বলে আওয়ামী লীগ নেতাকে জানিয়ে দেন। শেষে নাসিম সামাদকে ছাড়াতে গোদাগাড়ী থানার ওসিকেও ফোন করেন।
তবে ওসি পরোয়ানাভুক্ত কোনো আসামিকে ছাড়া সম্ভব নয় বলে আওয়ামী লীগ নেতাকে জানিয়ে দেন। এরই মধ্যে গোপন মাধ্যমে ঘটনাটি জানতে পারেন রাজশাহীর পুলিশ সুপার সাইফুর রহমান। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে এসআই আকরামের নেতৃত্বে অভিযানে বের হওয়া ছয় পুলিশ সদস্যের অবস্থান জানাতে বলেন গোদাগাড়ী সার্কেলের এএসপি সোহেল রানা ও গোদাগাড়ী থানার ওসি আব্দুল মতিনকে।
ছয় পুলিশের অবস্থান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা এলাকায় হওয়ায় এবং কোনো অনুমতি ছাড়াই নিজ থানার সীমানার বাইরে মাদক ব্যবসায়ী ধরতে যাওয়ায় পুলিশ সুপার অভিযানে থাকা পুলিশকে পুলিশ লাইনে ক্লোজড করার নির্দেশ দেন।
গোদাগাড়ী থানার ক্লোজড হওয়া পুলিশ কর্মকর্তারা হলেন- উপপরিদর্শক (এসআই) আকরাম হোসেন, এসআই সত্যব্রত সাহা, এএসআই মঞ্জুরুল ইসলাম, এএসআই রঞ্জু ইসলাম, এএসআই আব্দুল করিম ও কনস্টেবল মাহবুবুর রহমান। সোমবার দুপুর ১২টার মধ্যে তাদের রাজশাহী পুলিশ লাইনে রিপোর্ট করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহীর পুলিশ সুপার মো. সাইফুর রহমান জানান, শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজে জড়িত থাকায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।