সারিয়াকান্দি (বগুড়া) প্রতিনিধি : প্রতি বছরই বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনা বেড়েছে উদ্বেগজনকহারে। বগুড়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে বগুড়া সারিয়াকান্দির বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলের খোলামাঠে। বজ্রপাত থেকে নিজেদের প্রাণ রক্ষার্থে উপজেলার যমুনার প্রতিটি চরে বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র চান চরবাসী।
তবে বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি প্রশমনে ঝুঁকিপূর্ণ অন্যতম বজ্রপাতপ্রবণ জেলা বগুড়াতে পরীক্ষামূলকভাবে দু’টি বজ্র নিরোধক দন্ড বা লাইটেনিং অ্যারেস্টার বসিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান পল্লী উন্নয়ন একাডেমি। গবেষণা বলছে, সেই দুই বজ্রনিরোধকের দেড় কিলোমিটার সীমানায় গত এক বছরে কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
বগুড়ায় যমুনার করালগ্রাসে প্রতি বছরই সর্বস্বান্ত হয়ে এক চর থেকে অন্য চরে আশ্রয় নিতে হয় চরবাসীদের। নদীর সঙ্গে লড়াই করে চলে মানুষের জীবন-জীবিকা। চরের বেশিরভাগ মানুষই কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ঘরবাড়ি এবং বৃক্ষহীন বিস্তীর্ণ খোলা প্রান্তরে কাজ করতে গিয়ে বজ্রপাতে প্রায়ই মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন কৃষক-শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষ।
সরকারি হিসেবে গত চার বছরে বগুড়ায় বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে ৪০ জনের, যার অধিকাংশই চরাঞ্চলের কৃষক ও শ্রমিক। তাছাড়া এ ঘটনায় আহত হয়ে চিরজীবনের মত কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন অনেকে। বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় ২০১৫ সালে সরকার একে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে।
এ ঘটনায় মৃত্যুরোধে একাধিক প্রকল্পও নেওয়া হয়। এর মধ্যে একটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বজ্রনিরোধক যন্ত্র বসানো। এরই অংশ হিসেবে সারিয়াকান্দির নয়াপাড়া চরে গতবছর একটি বজ্র নিরোধক দন্ড বসিয়েছে বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমি। আরেকটি বসানো হয়েছে তাদের নিজস্ব ক্যাম্পাসে। বজ্রনিরোধক দন্ড উচ্চমাত্রার বিদ্যুৎকে নিরাপদে মাটির গভীরে পৌঁছানোর সুযোগ করে দেয়।
৩০-৪০ ফুট লম্বা দন্ডে তিন-চার ইঞ্চি জিআইপি পাইপ এবং তামার তার থাকে। দন্ডের ওপরে একটি ডিভাইস বসানো থাকে। যাকে লাইটেনিং অ্যারেস্টার বলে। এর মূল কাজ নির্ধারিত ব্যাসের মধ্যে বজ্রপাত হলে তা টেনে মাটিতে সরবরাহ করা।
সারাক্ষণ সক্রিয় থাকে এই যন্ত্র। এতে করে মাঠে নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারেন কৃষকরা। বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় যমুনার মোট ৭১টি চরে প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। এসব চরের মাঠে মাঠে আরো বজ্রনিরোধক দন্ড বসানোর দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
রংপুর কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের আরাজিহরিশ্বর গ্রামের সোলাইমান মন্ডলের ছেলে আব্দুর রশিদ মন্ডল (৪০) দিনমজুরের কাজ করতে এসেছিলেন বগুড়া সারিয়াকান্দিতে। গত ১৭ অক্টোবর উপজেলার কর্ণিবাড়ী ইউনিয়নের ডাকাতমারা চরে মরিচের জমি নিড়ানি দেওয়ার সময় বজ্রপাতে নিহত হন তিনি।
এ ঘটনায় একই গ্রামের আপান উল্লাহ মোল্লার ছেলে আশরাফুল ইসলাম (৪৫) ও সাহার উদ্দিনের ছেলে বাবু মিয়া (৫১) আহত হন। এটি এ উপজেলার বজ্রপাতে নিহত হওয়ার সর্বশেষ ঘটনা। চর এলাকায় কোন উঁচু গাছপালা এবং ঘরবাড়ি না থাকায় চরের কৃষক এবং শ্রমিকরা এ ধরণের দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। তাই চরাঞ্চলে বজ্রপাত নিরোধক দন্ড স্থাপনের দাবি এলাকাবাসীর।
দুর্ঘটনার শিকার ডাকাতমারা চরের আয়েন উদ্দিন বলেন, আমাদের চরাঞ্চলে বজ্রপাতে প্রতি বছরই বহু মানুষ এবং প্রাণি হতাহতের শিকার হচ্ছে, তাছাড়া ফসলেরও ক্ষতি হচ্ছে। তবে হাটশেরপুর ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামে বজ্রপাত নিরোধক দন্ড স্থাপনের ফলে সেখানে এ ধরণের কোনও ঘটনার সৃষ্টি হয়নি। তাই চরবাসীর দাবি নয়াপাড়ার মতো আমাদের প্রতিটি চরে বজ্রপাত নিরোধক দন্ড বসানো হোক।
বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির চর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক ড. আব্দুল মজিদ বলেন, বজ্রপাতে দেশের চরাঞ্চল এবং হাওর অঞ্চলে কৃষক শ্রমিকের মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বেড়ে গেলেও আমাদের স্থাপিত লাইটেনিং অ্যারেস্টারের ব্যাসের মধ্যে কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
তাই বজ্রাঘাতে কৃষক-শ্রমিকের প্রাণহানি ঠেকাতে চরাঞ্চলে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পর্যাপ্ত পরিমাণে বজ্রপাত নিরোধক দন্ড স্থাপন করা প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে পল্লী উন্নয়ন একাডেমি কাজ করছে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।